এ পুজোর সঙ্গে খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নিবিড় যোগ রয়েছে। প্রতিবার পুজোর সময় রাজ্যে থাকলে বাড়ির এই পুজোয় অংশ নিতে ভুলতেন না নেতাজি। এলাকাবাসীদের কাছ থেকে শোনা যায়, বসু বাড়ির এই দুর্গাপুজোর বয়স তিনশো পেরিয়েছে। একটা সময় জাঁকজমকপূর্ণভাবেই হতো এই দুর্গাপুজো। আজ সেই জৌলুস কমলেও কমেনি উন্মাদনা। বসু পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশই থাকেন বিদেশে বা ভিনরাজ্যে কিংবা এই এলাকার বাইরে কোথাও। তবে ফি বার দুর্গাপুজো এলে কোদালিয়ার এই বসুবাড়িতে জড়ো হন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের অনেক সদস্যই। বিশেষ করে অষ্টমীর দিন নেতাজির পরিবারের সদস্যদের অনেকেই এসে জড়ো হন এখানে। এবাড়িতে কাঠামো পুজোর প্রথাটি একটু ভিন্ন। বর্তমানে কাদের উদ্যোগে চলছে এই পুজো? সবটাই বিস্তারিতভাবে এই বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হল।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের কোদালিয়া। এখানেই রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়ি। এলাকাবাসীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, একটা সময় কোদালিয়ায় বসু পরিবারের দুর্গাপুজোয় সামিল হতেন গ্রামের সব মানুষজন। আদতে এটি বাড়ির পুজো হলেও বসুবাড়ির এই পুজোকে লোকে সর্বজনীন বলেই মনে করতেন। ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত ধুমধাম করে সাড়ম্বরে দেবী মহামায়ার আরাধনা চলে বসু বাড়ির ঠাকুরদালানে।
কোদালিয়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটের ঠাকুরদালান।
নেতাজির বাড়ির পুজোর ইতিহাস…
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঠাকুরদা হরনাথ বসুর আমল থেকে এবাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। আগে অষ্টমীর দিন সকালে অঞ্জলি ও সন্ধি পুজোর সময় গ্রামের প্রায় সব বাসিন্দাই বসু বাড়িতে হাজির হতেন। এককথায় নেতাজির বাড়ির এই পুজোকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকা সেই সময় গমগম করতো। চারদিন ধরে ধুমধাম করে চলতো পুজো। আজও পুরনো রীতি মেনেই হয় বসু পরিবারের এই দুর্গাপুজো। পরিবারের সদস্যরা যাঁরা দেশের অন্যত্র কিংবা বিদেশে থাকেন তাঁরা ফি বার পুজোর সময় এখানে আসেন। অষ্টমীর দিন কোদালিয়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বংশধরেরা সবাই একত্রিত হন। সন্ধি পুজোর পর কেউ কেউ চলে যান কেউবা থেকেও যান দিন কয়েক।
নেতাজি কি এ পুজোয় নিয়ম করে আসতেন?
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে বাড়ির এই দুর্গা পুজোয় সামিল হতেন। বিশেষ করে অষ্টমীর দিন এবাড়িতে নেতাজি প্রায়শই আসতেন। অষ্টমীর দিন সকাল থেকে সন্ধিপূজা পর্যন্ত এই ঠাকুরদালানেই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন সুভাষচন্দ্র। সন্ধ্যা আরতিতেও অংশ নিতেন তিনি।
শোনা যায়, সেই সময়ে এই এলাকার বহু বিপ্লবীর সঙ্গেও এবাড়িতে অনেক গোপন বৈঠক সেরেছেন নেতাজি। একদিকে যেমন পুজো চলতো তেমনই এবাড়ির কোনও এক প্রান্তে চলতো সেই বিপ্লবী-আলোচনা। আজও স্থানীয়দের পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বসু বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে যান অনেকে।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটে।
বহু বছর ধরে নেতাজির বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা বানাচ্ছেন শুভেন্দু চক্রবর্তী। আগে তাঁর বাবা প্রতিমা গড়তেন। বসু বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা গড়তে পেরে নিজেকে ধন্য বলে মনে করেন শুভেন্দুবাবু। তাঁর কথায়, "আগে বাবা গড়তেন এ বাড়ির প্রতিমা। এখন আমি প্রতিমা তৈরি করছি। আমি নেতাজির ভিটের প্রতিমা গড়ছি, এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওনা। অন্য জায়গায় রথযাত্রায় কাঠামো পুজো হয়। তবে এবাড়িতে জন্মাষ্টমীর দিনে কাঠামো পুজো হয়। প্রতি বছর আমি এখানে ঠাকুর দেখতে আসি। ওঁদের পরিবারের সদস্যরা বাইরে থাকেন। কিন্তু পুজোর সময় ওঁরা সবাই আসেন এখানে। খুব ঘটা করে পুজো হয়। আমিও আসি ঠাকুর দেখতে। নেতাজিও এখানে আসতেন বলে শুনেছি।"
বসু বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন পুরোহিত সুনীল চক্রবর্তী। বহু বছর ধরেই একাজ করে চলেছেন তিনি। তিনি বললেন, "সেই ১৯৭৬ সাল থেকে এবাড়িতে পুজো শুরু করেছি। আমার বাবাও এখানে নিত্য নারায়ণ সেবা করতেন। পুরনো রীতি মেনেই এখানে পুজো হয়। আগের চেয়ে পুজোর জাঁকজমক কমেছে। অষ্টমীর দিনেই পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য এখানে আসেন। এখন নেতাজির বড় ভাইপো দ্বিজেন বোসের দুই ছেলে সুপ্রিয় বসু ও চিত্তপ্রিয় বসুই পুজোটা চালাচ্ছেন। মায়ের সঙ্গে এই বাড়ির পুজোয় আসতেন নেতাজি। অষ্টমীর দিন এখানে আসতেন তিনি। এখানকার পুরনো বিপ্লবীদের সঙ্গে বসে নানা আলোচনাও করতেন।"