শ্রমিকের কাজে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে ভয়ানক পরিণতির শিকার হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এক দম্পতি। রেহাই মেলেনি তাঁদের দেড় বছরের শিশুপুত্রেরও। বাংলাভাষী এই দম্পতিকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে তকমা সেঁটে দিয়ে জেলে পুরেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ।
প্রায় তিন মাস ধরে শিশুপুত্র আদিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরুর জেলেই দিন কাটাচ্ছেন দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী। তাঁদের বাবা-মা বেঙ্গালুরুর পুলিশকে ছেলে ও বউমার ভারতীয় নাগরিকত্বের সমস্ত প্রমাণপত্র দেখিয়েছেন। কিন্তু তাতেও লাভ কিছু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ছেলে-বউমা ও নাতির বেঙ্গালুরুর জেল থেকে মুক্তির জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন অসহায় বাবা-মা।
দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের জৌগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা। এখানকারই তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা তাঁরা। সেখানে রয়েছে তাঁদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্র্যতাই
অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। পলাশদের মতোই তাঁদের প্রতিবেশীরাও অত্যন্ত গরিব। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই শুধুমাত্র তাঁদের সম্বল। পলাশদের প্রতিবেশীদেরও অনেকে দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালান। বাকিদের কেউ বালাপোশ তৈরি কেউ আবার বিড়ি বাঁধার কাজে যুক্ত রয়েছেন।
এমনই একটি গ্রামের ছেলে পলাশ রোজগারের আশায় স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোজগার তো দূরের কথা, উল্টে সেখানে তাঁদের পরিণতি হয়েছে ভয়ঙ্কর। যা জেনে স্তম্ভিত তেলে গ্রামের বাসিন্দা এবং জনপ্রতিনিধিরাও।
তেলে গ্রামেই বাস করেন পলাশঅধিকারীর আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার । তিনি বলেন, “শ্রমিকের কাজ করার জন্য চলতি বছরের জুন মাসে শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়েই পলাশ তাঁর স্ত্রী বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিল। একই উদ্দেশ্যে পলাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী ও মা সবিতাদেবী এবং প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীও বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন। সেখানকার মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর(varthur) থানার সুলিবেলে(sulibela) গ্রামে ওঠেন তাঁরা। স্থানীয় কায়েন খানের বাড়িতেই তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে কায়েনের অধীনেই তাঁরা কাজ শুরু করেন। হোটেল, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্য, বোতল ও প্লাস্টিকের সরঞ্জাম বাছাই করাই তাঁদের কাজ ছিল।
আরও পড়ুন- ধেয়ে আসছে সিত্রাং, চূড়ান্ত সতর্ক রাজ্য, কোন কোন জেলায় ঝড়ের বেশি প্রভাব?
পিন্টু হাওলাদার বলেন, “সেখানে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ করেই গত ২৭ জুলাই ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খানের ডেরায় হানা দেয়। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তাঁরা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ তাঁদের ও আরও পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। পলাশ, তাঁর স্ত্রী ও বাবা-মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী সবাই ভারথুর থানার পুলিশ কে জানান তাঁরা কেউই বাংলাদেশি নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে নিজের নিজের আধার কার্ড,প্যান কার্ড,ভোটার কার্ডও দেখান।''
পিন্টু আরও বলেন, ''সেই সব দেখে সেখানকার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা, মা ও প্রতিবেশীকে ছেড়ে দিলেও পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র-সহ সাত জনকে আটকে রেখেছে। সেই থেকে প্রায় তিন মাস শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী বেঙ্গালুরুর জেলেই দিন কাটাচ্ছে।''
আরও পড়ুন- কীভাবে জন্ম হল দেবী কালীর, কেন তিনি রক্তপান করেছিলেন? পুজোর নির্ঘণ্ট
সুনীল অধিকারী বলেন, ''আমিও রোজগারের আশায় পলাশদের সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলাম। ভারথুর থানার পুলিশ আমাকেও সন্দেহে ধরে। ওখানকার পুলিশের সঙ্গে আমাদের কথা বলার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা হচ্ছিল। ওরা আমাদের কথা যেমন বুঝতে পারছিল না, তেমন আমরাও ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবুও আমি, পলাশের বাবা- মা ও পলাশ বাংলাতেই পুলিশকে আমরা ভারতীয় তা চেঁচিয়ে বলতে থাকি। তেলে গ্রামে থাকা আমার স্ত্রীর ফোন নাম্বার ওরা চেয়েছিল। সেটাও দিয়েছিলাম। এর পর ওরা কি বুঝলো জানি না। আমাকে এবং পলাশের বাবা ও মাকে ছেড়ে দেয়।''
পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তান এখনও বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি। সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়েছে বলেই দাবি সুনীল অধিকারীর। হুগলীর বৈচিগ্রামে বাড়ি পলাশের আত্মীয় সুজন হালদারের। তিনি বলেন, “পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের এমন করুণ পরিণতির কথা জেনে আমিও ওঁদের পাশে দাঁড়াতে বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলাম। কোনও ভাবেই কিছু সুরাহা করতে পারছি না। যে আইনজীবীকে ধরেছি তিনিও আশানুরূপ সহযোগিতা করতে পারছেন না।''
আরও পড়ুন- দেবীর নাম কালী কেন, কেন দেবীর পায়ের তলায় মহাদেব?
পলাশের বাবা-মা বলেন, ''এখন মুখ্যমন্ত্রীই আমাদের ভরসা। উনিই আমদের ছেলে-বউমা ও নাতিকে বেঙ্গালুরুর জেল থেকে ছাড়াতে পারবেন। মুখ্যমন্ত্রীই কিছু একটা করুন। যাতে ফের আমরা আমাদের ছেলে-বউমা ও আদরের নাতিকে ফিরে পেতে পারি।''
এপ্রসঙ্গে বিডিও ( জামালপুর ) শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, “এমন একটা ঘটনার কথা আমি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনকে
ওয়াকিবহাল করা হয়েছে। এসডিও (বর্ধমান দক্ষিণ) সাহেবও বিষয়টি দেখছেন।'' অন্যদিকে, জামালপুরের বিধায়ক অলোক মাঝি বলেন, ''পলাশ অধিকারী ও তাঁর পরিবার আমার বিধানসভা এলাকার তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ও ভোটার। ভারতীয় নাগরিকত্বের সমস্ত প্রমাণপত্রও তাঁদের রয়েছে। তা সত্ত্বেও কোন যুক্তিতে বেঙ্গালুরুর পুলিশ পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে আটকে রেখেছে, সেটাই আশ্চর্যের।'' বিধায়ক জনিয়েছেন, কালী পুজো মিটলেই তিনি এই বিষয়টি নিয়ে জেলাশাসকের মাধ্যমে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।