করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের সামগ্রিক আর্থিক অসঙ্গতির সঙ্গে খুব বড় ধাক্কা খেয়েছে রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা। লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ২ বছর হতে চলল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ দেখেনি ছাত্র-ছাত্রীরা। নতুন ভাবনায় অনলাইন ক্লাসের দৌলতে অনেক কিছুই উদীয়মান। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরীক্ষাগ্রহণ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ এখন জুম এবং গুগল মিট। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে স্কুল আদৌ এই পরিস্থিতিতে খোলা উচিত কিনা সেই নিয়েও মতান্তরের শেষ নেই। অতিমারীর প্রভাবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আতঙ্কিত শিক্ষক থেকে ছাত্রসমাজের সকলেই। ড্রপআউট বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রথম থেকে প্রশ্ন তুলেছে বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই। তার মূল কারণ এর ফলে শিক্ষায় বিভেদ তৈরি হচ্ছে। সকলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যদিও এবিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃনাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলেন, “অনলাইন এবং অফলাইনের ক্ষেত্রে বেশ বিভেদ রয়েছে। প্রথমেই বিষয়টিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধে হয়। কারণ অনলাইনে প্রশ্ন করার সুযোগ একেবারেই ছিল না। তবে যারা সহজেই এই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে এটি লাভদায়ক। একই বিষয় বারবার তারা ঘুরিয়ে জেনে বুঝে নিতে পারে”। তিনি বলেন, “শহর কলকাতায় আগের বছরের থেকে মফস্বল এবং গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সংখ্যা একটু হলেও বেড়েছে। আগের বছর সংখ্যা একেবারেই কম ছিল তবে এবার হার একটু বেশি। তবে ড্রপ আউট প্রসঙ্গে তাঁর মতামত, 'সরকার পক্ষ থেকে টেকনিকাল বিভাগে অনেককে সাহায্য করা হয়েছে। ভার্চুয়ালি অনেক ক্লাস একসঙ্গে করতে গিয়ে ডেটা শেষ হয়ে গিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটছে'। তাঁর মতে, যদি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে ইন্টারনেট পরিষেবায় সুবিধে দেওয়া হয় তাহলে আরও ভাল হয়।
আরও পড়ুন- ডবল ডোজের আত্মবিশ্বাসে ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ! মাস্কহীন উল্লাসে সংক্রমণের হাইজাম্প
এসএফআই প্রথম থেকেই অনলাইনের ক্ষেত্রে শিক্ষার বিভেদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাঁরা রাস্তায়, ফুটপাতে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বলেন, 'মানুষের নিজস্ব নীতিবোধ একেবারেই কমে যাচ্ছে। তা বলে টেকনোলজির বিরোধিতা করার কোনও জায়গা নেই। তারপরেও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে গেলে সবার মধ্যে সমান ভাবে তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রামীণ এবং গরীব ছাত্র-ছাত্রীরা বাদ পরে যাচ্ছে। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ছে। অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভরশীল হতে গেলে এর নীতিবোধ নিয়ে বিবেচনা করা দরকার। ক্লাসের যে প্রথাগত বিষয়টি এতদিন ধরে চলে আসছে সেই দিকে একেবারেই হাত দেওয়া উচিত নয়। অনেক এমন আছেন, যারা ক্লাসে ক্যামেরা অন করে বসে থাকলেও শিক্ষকের কথা কানেও দিচ্ছে না এতে না হচ্ছে পড়াশুনো, না হচ্ছে মানবিক শিক্ষা। এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ এবং মনস্তাত্বিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা দরকার।' অফলাইন শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার দাবি জানান সৃজন। তাঁর মতে, স্কুল কিংবা কলেজগুলোতে মাঠ কিংবা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। দরকার পড়লে যারা আসতে চাইছে তাদের অবশ্যই অফলাইন শিক্ষা দেওয়া উচিত।
তবে বিজেপির ছাত্র সংগঠন অনলাইন ক্লাসের ওপর জোর দিচ্ছে। এবিভিপির রাজ্য সভাপতি সুরঞ্জন সরকারের বক্তব্য, 'প্রথম থেকেই অনলাইন মাধ্যমে পড়াশোনার বিষয়টিতে আমরা একেবারেই সহমত ছিলাম । শিক্ষার্থীদের প্রাণের তাগিদেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যখন করোনা মহামারীর প্রকোপ বেশ কিছুটা কম তখন কিন্তু ধীরে ধীরে স্কুল কলেজ খোলার বিষয়ে অবশ্যই দৃষ্টি দেওয়া উচিত।' তাঁর স্পষ্ট দাবি, 'শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্যানিটাইজ করে, তাদের ক্যাম্পাসে আসার বন্দোবস্ত করা হোক। ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তাঁর মত, গ্রামের প্রান্তিক স্তরের ছাত্রছাত্রীরা অনেক পিছিয়েগেছেন এই কারণে। আমফান এবং ইয়াশের পর সেখানকার অবস্থা আরও শোচনীয়। ফলে পরীক্ষা-বৃত্তিতেও খুবই অসুবিধে ভোগ করছে তারা। অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেনার সামর্থ্য তাদের অনেকের মধ্যেই নেই। বড় সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীরা অফলাইনে ক্লাস করতে প্রস্তুত।'
আরও পড়ুন- ফেরেনি হুঁশ, ‘রক্তচক্ষু’ ভিড়, তৃতীয় ঢেউ আতঙ্কে জেরবার চিকিৎসকমহল
শিক্ষককূলও করোনা আবহে শিক্ষার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। ডা: গৌতম কুন্ডু(অধ্যক্ষ, বিদ্যাসাগর কলেজ ) বলেন, 'সবসময় নতুন কিছু শুরু করতে গেলে একটি উপলক্ষ্য লাগে। ডিজিটাল মাধ্যমে এই পড়াশোনা করোনা আবহে আমাদের কাছে টেকনিকাল দিকে এক নতুন প্রাপ্তি। বহুবছর ধরেই ক্লাসরুমের শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে ঠিকই তবে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে টেকনোলজির সঙ্গে হাত মেলানো বেশ দরকার। এদিন আর বেশি দেরি নেই যেদিন ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় সহজেই জায়গা করে নেবে মানুষের মধ্যে। আর প্রশ্ন হল শেখার। তার মতে, ক্লাসরুমে বসে থেকেও মেন্টালি প্রেজেন্ট থাকে না এমন অনেক স্টুডেন্ট আছে, বরং এই ডিজিটাল শিক্ষার যুগে যদি কোনও সময় মানসিক ভাবে তার সেই বিষয়ে স্থিতি না থাকে তবে পরবর্তীতে সেটি জেনে বুঝে নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে মাথায় রাখতে হবে ব্যবহারিক বিভাগের বিষয়গুলির। প্রাক্টিকাল বিষয়গুলিতে কলেজের অবশ্যই হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে অফলাইন শিক্ষার দরকার অবশ্যই আছে। আবার ড্রপ আউটের সংখ্যাও বেশ বেড়েছে বলেই তিনি জানান। করোনা আবহে ঢালাও পাশ করেছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকস্তরের ছাত্র-ছাত্রীরা। তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় শিক্ষকমহল। গৌতমবাবু বলেন, বিগত দুই বছরে সকলেই পাশ করে গেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির সঙ্গে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অনেকেরই নেই।'
অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় অশনি সঙ্কেত দেখছেন বিদ্যাসাগর কলেজের সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান ডক্টর সোনারেখা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “প্রথমে আদতে ভেবেই পাইনি কীভাবে ক্লাস নেওয়া হবে। এবং আসলেই থিয়োরি পড়ানো সম্ভব হচ্ছিল, প্রাক্টিকাল ক্ষেত্রে বেশ অসুবিধে হয়। তবে নেতিবাচক প্রভাব বেশি। এবং যারা টেকনিক্যাল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত নয় সেই সমস্ত শিক্ষকদের কাজ করা বেশ অসুবিধে হয়। তার সঙ্গে অবশ্যই আর্থিক অবস্থার দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। ডেটা কিংবা নেটের বিষয়ে অনেকেরই সেই সামর্থ নেই, সুদূর গ্রামেও অনেকে থাকেন যাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়”। শিক্ষার মান বেশ কমে যাচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন। পাশাপাশি তিনি বলেন, নানান রকম অসদ উপায় শিক্ষার্থীরা অবলম্বন করছে। ভাল শিক্ষার্থীদের এতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে।
আরও পড়ুন- বাংলায় ফের করোনার দাপাদাপি, রইলো হাসপাতাল-বেড-হোম আইসোলেশনের তথ্য তালাশ
বিদ্যালয়ের বিভাগে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা কিন্তু বেশ লক্ষ্যণীয়। শ্রীমতি রত্না ভট্টাচার্য (শিক্ষিকা, হুগলি গার্লস হাই স্কুল) এই প্রসঙ্গে বলেন, 'অনলাইন ক্লাস চলছে এই বিষয়টাই আধাআধি সত্য। এমনও গ্রাম আছে যেখানে ইন্টারনেট পৌঁছায় নি। আর শহর কিংবা মফস্বল অঞ্চলে বাবা মায়েদের একটি করে ফোন। সবসময় অনলাইনে পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। এবং বাচ্চাদের সারাক্ষণ এই ফোন নিয়ে বসে থাকার বিষয়টি ওরা দিনদিন আসক্ত হয়ে পড়ছে।' শিক্ষক প্রশিক্ষক মণীশ পান্ডা মনে করেন, 'ছাত্র ছাত্রীদের নতুন পথে চালনা করার বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে সাইকোলজিকাল একটি পরিবর্তন সকলের মনেই দানা বেঁধেছে। তাই সেই দিকে আগে আলোকপাত করা উচিত এবং বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে।'
শুভ্র কুমার চক্রবর্তী ( হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের শিক্ষক ) বলেন , 'শহরের দিকে যদিও বা সম্ভব অনলাইনে ক্লাসের ব্যাপ্তি গ্রামাঞ্চলে সেই সংখ্যা প্রচুর কম। অনেকেরই আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে এই সময়ে। খাওয়াদাওয়ার সুযোগের অভাব তারপরে তো অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনার বিষয়ে তারা ভাবছে। অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। আর সবথেকে বড় ব্যাপার ছেলেমেয়েদের না দেখে বোঝার অভিপ্রায় একেবারেই নেই যে তারা বিষয়টি সম্পর্কে বুঝছে কিনা ফলেই শিক্ষার গভীরতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। স্কুল মানে শুধুই পড়াশোনা নয়, অনেক নিয়মের মধ্যে দিয়ে পথ চলা সেইদিক গুলো এই দুইবছরে হারিয়ে গেছে। আর যদি তাদের অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণের হার প্রসঙ্গে বলা হয়, তবে সেটি খুবই কম। ৫০ শতাংশ হবে বলেও আশা করা যায় না। অবিলম্বে তাদের ছাত্রজীবন বাঁচাতে গেলে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।'
একদিকে অনলাইন শিক্ষার সামগ্রিক ব্য়বস্থা এখনও সম্ভব হয়নি। আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো এতটা দৃঢ় নয় যে এই প্রক্রিয়ায় রাজ্য়ব্য়াপী শিক্ষাপ্রদান করা সম্ভব। পাশাপাশি ড্রপ-আউটের সংখ্যাই বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে শিক্ষামহল। স্কুল-কলেজ খুললেই সামগ্রিক শিক্ষার হাল কি তা অনেকটাই পরিস্কার হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন