রাজনীতিতে এ যেন সত্যিই এক দৃষ্টান্ত! রাজনৈতিক দলগুলি একটা গোটা পরিবারকে তাঁদের সঙ্গে ভিড়িয়েছে। একটা পরিবার যেন সর্বদলীয় রাজনীতির মিলনক্ষেত্র হয়ে গিয়েছে। তবে তাতেও সংঘাতহীন দুই বউমা ও কাকিমা-শাশুড়ি।
স্বপ্না দাস, রীনা দাস ও অর্চনা দাস নামের এই তিন মহিলা পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার গোশুম্বা গ্রামের বাসিন্দা। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই তিনজন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ভোট যুদ্ধে সামিল হয়েছেন। ছোট জা স্বপ্না তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন। বড় জা রীনা আবার সিপিএমের হয়ে পঞ্চায়েত আসনে প্রার্থী হয়েছেন। আর বাড়ির দুই বউমার সঙ্গে জোর টক্কর দিতে কাকিমা-শাশুড়ি অর্চনা দাস পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বিজেপির প্রার্থী হয়ে ভোটের লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। তবে শাশুড়ি-বউমারা কেউই রাজনীতির ময়দানের উত্তাপের আঁচ বাড়িতে পৌঁছোতে দেননি। বরং একে অপরের পরিপূরক হয়ে সংসার সামলে তাঁরা ঘরের শান্তিও বজায় রেখেছেন। রান্না করা, তরি-তরকারি আদান প্রদানও যথারীতি আগের মতোই চলছে।
পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পর থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়েছে রাজ্যজুড়ে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে রাজনৈতিক হিংসা হানাহানির ঘটনাো। পাহাড় থেকে সমতল, সর্বত্রই একই চিত্র। রক্ত ঝরছেই। এমন এক অশান্ত পরিস্থিতিতে কাটোয়ার গোশুম্বা গ্রামের দাস পরিবারের তিন বধূ এখন যেন হিংসা মুক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। আর তার দৌলতেই তাঁরা কাটোয়াবাসীর মন জয় করে নিয়েছেন। পৃথক তিন দলের প্রার্থী হয়ে একই পরিবারের তিন বধূর এমন শান্তিপূর্ণ লড়াই বঙ্গ রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন কাটোয়ার ভোটাররা ।
আরও পড়ুন- আজ প্রবল বৃষ্টি জেলায়-জেলায়, কাল থেকেই দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়ায় তুমুল বদল!
একটা সময় ছিল যখন ভোট এলেই খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিত কাটোয়া-১ ব্লকের আলমপুর পঞ্চায়েতের গোশুম্বা গ্রাম। আগে এই গ্রামে সিপিএমের দাপট ছিল সীমাহীন। তবে দাপট দেখানোর ব্যাপারে কংগ্রেসও পিছুপা ছিল না। ২০১১ সালে গোশুম্বা গ্রামে খুন হন সিপিএম নেতা নারায়ণ দাস। তার জেরে গ্রামে হিংসা মাত্রা ছাড়ায় । একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন গ্রামে স্থায়ীভাবে বসানো হয় পুলিশ পিকেট।
রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদলের পর ধীরে ধীরে গোশুম্বা গ্রামে রাজনীতির ভোল পাল্টাতে শুরু করে। কংগ্রেসের বেশিরভাগ কর্মী যোগদান করেন তৃণমূলে। ২০১৪ সালের পর থেকে গ্রামে মাথাচাড়া দেয় বিজেপি। গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে অন্য দল গুলিকে পিছনে ফেলে গোশুম্বা গ্রামে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তৃণমূল, সিপিএম রয়েছে তৃতীয় স্থানে। এমন এক গ্রামে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে হিংসা মুক্ত রাজনীতির আইকন এখন দাস পরিবারের তিন বধূ ।
গ্রামের তৃণমূল প্রার্থী স্বপ্না দাসের বাড়িতে বুধবার গিয়ে দেখা যায় তিনি সংসারের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। প্রচারে যাচ্ছেন না? এই প্রশ্ন করতেই স্বপ্নার স্পষ্ট জবাব, 'দিদি মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের দলের প্রার্থী হয়েছি। প্রচারে বের হব না! সেটা কি করে হয়। সংসারের কাজ সেরেই দলের নেতা কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি প্রচারে যাচ্ছি। সবাইকে বলছি,আমাদের মমতা দিদি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা জনমুখী প্রকল্প চালু রেখেছেন। বিনে পয়সায় রেশনে চাল দিচ্ছেন, মহিলারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে ,নি খরচায় চিকিৎসা পরিষেবা পাবার জন্য স্বাস্থ্যসাথী চালু করেছে।' স্বপ্নার দাবি, সরকারের কাজে খুশি মানুষ, তাই তাঁরা তাঁকেই জেতাবেন বলেই মনে করছেন তিনি।
স্বপ্না যখন তৃণমূলের হয়ে এত সব কথা বলছেন তখন পাশের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে সিপিএম প্রার্থী রীনা দাস বলেন, 'কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই উন্নয়ের নামে সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে। তাই মানুষ আমাদের অর্থাৎ সিপিএমের প্রতি ফের আস্থা রাখবেন। আমাকেই জয়ী করবেন।' বাড়ির এক বউমা তৃণমূলের হয়ে আর অপর বউমা সিপিএমের হয়ে যখন সওয়াল করছেন তখন বিজেপির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন কাকি-শাশুড়ি অর্চনা দাস। দুই বউমার বক্তব্য শুনে তিনি চুপ করে থাকেন কি করে! তিনি বলেন, 'তৃণমূল নয়, সিপিএমও নয়। দেশের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন একমাত্র বিজেপিই করতে পারে। বাংলার মানুষও সেটাই বিশ্বাস করেন। তাইতো গোশুম্বা গ্রামের মানুষ গত দুটি ভোটে বিজেপিকেই এগিয়ে রখেছে।' তাই এবারের পঞ্চায়েত ভোটে গোশুম্বা গ্রামের মানুষ তাঁকেই ভোট দিয়ে জয়ী করবেন বলে আশাবাদী অর্চনাদেবী।
একই বাড়ির সদস্য হয়েও তিনজন যুযুধান তিন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়েছেন বলে সংসারে অশান্তি হচ্ছে না? এর উত্তরে দুই বউমা স্বপ্না ও রীনা এবং কাকিমা-শাশুড়ি অর্চনাদেবী এক সুরে বলে ওঠেন , 'অশান্তি কেন হবে! আমাদের সংসারে কোনও দিন অশান্তি ছিল না। আর অশান্তি হবেও না। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। আর সংসার সংসারের জায়গায় থাকবে। ভোট সাময়িক সময়ের ব্যাপার ,কিন্তু সংসার সারা জীবনের।'
তিনজনই প্রায় এক সুরে জানিয়েছেন, তাঁরা বাড়ির শান্তি ভোটের ময়দানেও দেখতে চান। গ্রামের মানুষ তাঁদের পছন্দ মতো যাঁকে খুশি ভোট দেবেন। গ্রামে তাঁরা অসান্তি হতে দেবেন না বলে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। গ্রামবাসী স্বপন দাস বলেন, 'দাস পরিবারের তিন প্রার্থী প্রকৃত অর্থেই দেশের রাজনীতিতে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছেন। এমন রাজনীতিরই এখন খুব প্রয়োজন।'