Advertisment

নারী দিবস: ‘ব্যর্থতা সাময়িক, কিন্তু সাফল্য আজীবন’, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে কলম ধরলেন WBCS সৌম্যা শীল

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সফল হওয়ার কাহিনী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

নিজের অফিসে সৌম্যা শীল। ছবি: সৌম্যা/ফেসবুক

ব্যর্থ প্রেম সাফল্যের সাময়িক প্রতিবন্ধকতা, কিন্তু কখনই গিভ আপ নয়। আমার জীবন দিয়ে সেটা বলতে চাই। আমি সৌম্যা শীল পেশাদার ডবলুবিসিএস (WBCS) অফিসার, মডেলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষাবিদ, লেখক এবং প্রেরণাদায়ী বক্তা। কিন্তু একসঙ্গে এতগুলি রূপে অবতীর্ণের পথ খুব একটা সাবলীল নয়। কন্টকপূর্ণ তো বটেই। সেই কথা বলতেই আমি কলম ধরলাম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়। উইপ্রো ব্যাঙ্গালোরে উচ্চপদে কাজ করতে করতে ভুল জীবনসঙ্গী চয়ন। প্রেমে যখন হাবুডুবু, তখনই বুঝলাম আমার সিদ্ধান্ত ভুল।ফল ব্যর্থ প্রেম বয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া।যা আমার ৩ বছরের পেশাগত জীবনকে ধ্বংস করে দিল। তিন বছর বেকার জীবন যাপন। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ল শরীরে। ফলে ভগ্ন স্বাস্থ্য, ভগ্ন হৃদয় আর ঝোলাভর্তি উচ্চশিক্ষা নিয়েও বেকার জীবনের যাত্রাপালা শুরু। সেটা ২০১৩ সাল।

Advertisment

যদিও ২০১৩ সালের আগেও একটা জীবন ছিল। লক্ষ্য ছিল নিজের নামের আগে ডক্টরেট বসানো। সেই লক্ষ্যে দৌড়তে প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতকোত্তর এবং জিআরই পাস করে বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি। কিন্তু বাংলা বরাবর আমার শিকড়। সেখানেই জন্ম, প্রেসিডেন্সি কলেজ। যদিও বাবার কর্মসূত্রে বেড়ে ওঠা দিল্লিতে।তাই কলকাতাকে আপন করে নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করি।বেকারদের একটা সমস্যা থাকে, আর্থিক অনটনের পাশাপাশি কাছের লোকেরাও অনেক সময় চিনতে ভুল করেন। আমার সঙ্গেও সেটা হল। শহরের উষ্ণতম দিনগুলোতে ঠাটাপোড়া রোদ মাথায় নিয়ে শুধু একটু রেফারেন্সের খোঁজে কলকাতার এদিক-সেদিক ঘুরতাম। যেহেতু আমার কর্মজীবনে ৩ বছরের গ্যাপ ছিল, তাই সেভাবে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।

এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মনের কোথাও সঙ্কল্প ছিল সমাজসেবায় বা মানুষের কাজে নিজেকে যুক্ত করব। সেই সঙ্কল্পকে পাথেয় করেই নিজেকে মনে মনে তৈরি করলাম। ইউপিএসসি (UPSC) আর ডবলুবিসিএস (WBCS)-এর প্রস্তুতি শুরু করলাম। যারা এই দুটি পরীক্ষার সঙ্গে ওয়াকিবহাল, তারা জানেন প্রিলিম পাশ করা যতটা সোজা, ততটাই কঠিন মেইন পাশ করা। তবে আপনি যদি পড়াশোনা ও চর্চার মধ্যে থাকেন তাহলে একটু সময় দিলেই এই দুটি পরীক্ষা পাশ করা যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সময় ছিল প্রতিকূলে। প্রায় ৫-৬ বছর বইয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, ছিল না চর্চা। তাও আমি করবই জয়, এই সঙ্কল্প বয়ে প্রস্তুতি শুরু করি। প্রথম সুযোগেই প্রিলিম পাশ করি। কিন্তু সেটা প্রথম হার্ডল, সবচেয়ে বড় জগদ্দল পাথর ছিল মেইন। অন্তত তিন বছর মনোযোগী হলে মেইন লেখা পরীক্ষা-সহ ইন্টারভিউ পাশ করা সম্ভব। আমার ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে।

২০১৫ সালে যখন প্রিলিম পাশ করে মেইনের প্রস্তুতিতে মগ্ন, তখন হঠাৎ আমার শ্রবণ যন্ত্রের সমস্যা হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম অত্যাধিক চাপ ও রাত জেগে পড়ার ফল। তাই প্রথম প্রথম চাপ কমিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তাম। তারপরেও থেকে গিয়েছিল সেই সমস্যা। বেগতিক বুঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিই। কিছু পরীক্ষার পর আমার ককলিয়ার অটোসক্লেরোসিস ধরা পড়ে। গোদা বাংলায় শ্রবণ যন্ত্র প্রায় বিকল হয়ে যাওয়া। কানের মধ্যে সবসময় একটা গোঁ-গোঁ শব্দ। কানের এই সমস্যার সঙ্গে ধরা পড়ে ভার্টিগো। এই দুয়ের গেরোয় আমি সম্পূর্ণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ব্যর্থ প্রেম, সাময়িক বেকারত্ব অনেক বেশি যন্ত্রণার। মানসিক ভাবে আপনাকে পুরো পর্যুদস্ত করে দেয়। তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আগে সেটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। কারণ এখানে মনের পাশাপাশি আমাকে শরীরের সঙ্গেও লড়তে হয়েছে। ডাবলুবিসিএস মেইন পরীক্ষার প্রস্তুতির যে চাপ, সেটা ভগ্ন মন আর শরীর নিয়ে সাড়া মারাত্মক। আমার মতো পরিস্থিতির মধ্যে যারা পড়েছেন তাঁরাই সেটা বুঝবেন।কোথায় যাব, কী করব, কার সাহায্য নেব? সে যেন এক অসহনীয় পরিস্থিতি। কিন্তু গায়ক বলেছে হাল ছেড়ো না বন্ধু…। সেই হাল না ছাড়ার সঙ্কল্প নিয়েই আল ইস ওয়েল বলে নেমে পড়লাম। কারণ আমার সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা আমাকেই মেটাতে হবে। তাই মনোবল বাড়িয়ে হার্ডল পেরোতে আয়নাকে আমার সহযোদ্ধা বানালাম। যখনই অসহনীয় কষ্ট হত, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।

পড়া শুরু করলাম পদ্য, কবিতা। পুরো মাখনের মতো মনের সব অন্ধকার দূর হতে শুরু করল। পদ্য থেকে অনুপ্ররণা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। মনের ভাব প্রকাশ করা শুরু করলাম। লিখতে লিখতেই আমি আবিষ্কার করলাম আমার ডিসগ্রাফিয়া আছে। এই রোগ আমাকে একসঙ্গে অনেকক্ষণ পেন বা পেন্সিল হাতে ধরে রাখতে দিত না। এই প্রতিবন্ধকতার সুরাহা কী? নেট ঘেঁটে পেলাম মান্ডালা আর্টের ব্যবহার। ক্রমে ডিসগ্রাফিয়া আমাকে মুক্তি দেওয়া শুরু করল।

এভাবে একের পর এক হার্ডল পেরিয়ে ডাবলুবিসিএস অফিসার হিসেবে আমার প্রথম নিয়োগপত্র হাতে পাই ভূমি-রাজস্ব দফতরে। সেই নিয়োগপত্র আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো আমার মনে একটাই মন্ত্র আসতে থাকে, এভাবেও ফিরে আসা যায়। নিজেকে কামব্যাক কুইন হিসেবে তুলে ধরার যে লড়াই সেটাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় নিজের কলমে লিখলাম। তবে আমার কাহিনী এখানেই শেষ নয়। সরকারি চাকুরে শুধু নয় নিজের শখ পূরণে মডেলিংয়ে নামি। খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই আর সেটাই বদলে দেয় আমার জীবন। এখন ছুটির দিনে কমবেশি ফ্যাশন শো কিংবা মিউজিক ভিডিওর কাজ আমাকে প্রশান্তি দেয়। এখন প্রশ্ন কীভাবে দুটি সামলাই? জবাব, যেভাবে ব্যর্থতা সরিয়ে ডাবলুবিসিএস অফিসার হয়েছি ঠিক সেভাবেই দু’টি পেশাকে সামাল দিতে আমি শক্তি পেয়েছি।

আমি চেয়েছিলাম আমার এই লড়াই আর পাঁচজন প্রত্যাশীর কাছে পৌঁছে দিই। সেই সুযোগ আমাকে করে দিয়েছে আনএকাডেমি (Unacademy)। ওদের এডুকেটর হিসেবে আমি প্রায়ই নিজের কাহিনী তুলে ধরে অন্যদের প্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করি। আরা এতেই আমি খুশি। দিনের শেষে চোখ বোঝার আগে এটাই মনে হয়, ‘ব্যর্থতা সাময়িক।মনের ভিতর ফিরে আসার তাগিদ থাকলে লক্ষে পৌঁছন সম্ভব।‘ কারণ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘ওঠো জাগো লক্ষে না পৌঁছন পর্যন্ত থেম না।‘

অনুলিখন: জয়দীপ সেন

Women's Day
Advertisment