Advertisment

'হিসেব ভুল হলেই স্যারের কাছে ছুটে যাই'

কোনোদিন শুনেছেন, 'ন্যায্য মূল্যের খাতা পেন্সিল আর্টপেপারের দোকান'? মুর্শিদাবাদের এই বিদ্যালয়ের মধ্যেই কচিকাঁচাদের সাহায্যে তৈরি হয়েছে ছোট্ট 'ন্যায্য মূল্যের' দোকান, যেখানে পড়ুয়ারা ক্রেতাও বটে, বিক্রেতাও।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সুলভ মূল্যে, শিশুদের দ্বার পরিচালিত

এরাজ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরেই দুখিনী দুয়োরানীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। খুব বেশি অভিভাবক বোধহয় নেই যাঁরা তাঁদের সন্তানদের সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠাবেন। এবং তা যদি হয় কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাহলে তো হিসেবের মধ্যেই আসে না।

Advertisment

তবে কখনো কখনো ছবিটা বদলায়। সেই রকমই বদলে যাওয়া ছবির উদাহরণ স্বরূপ উঠে এলো মুর্শিদাবাদে হরিহরপাড়ার ৬৪ নং ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানকার খুদে শিক্ষার্থীরা তাদের মৌলিক ভাবনা এবং কর্মক্ষমতা দিয়ে সকলকে, মায় প্রশাসনিক কর্তাদের পর্যন্ত, তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

'ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান'। সবাই শুনেছেন এই ধরনের দোকানের কথা। কোনোদিন শুনেছেন, 'ন্যায্য মূল্যের খাতা পেন্সিল আর্টপেপারের দোকান'? এখানেই অবাক করেছে মুর্শিদাবাদের এই স্কুল। বিদ্যালয়ের মধ্যেই কচিকাঁচাদের সাহায্যে তৈরি হয়েছে ছোট্ট 'ন্যায্য মূল্যের' দোকান, যেখানে পড়ুয়ারা ক্রেতাও বটে, বিক্রেতাও।

আরও পড়ুন: রাজ্যের ১.৭ কোটি সংখ্যালঘু পড়ুয়াকে স্কলারশিপ দিয়েছে সরকার: মমতা

পঠনপাঠন সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস - পেনসিল থেকে ইরেজার, খাতা থেকে আর্টপেপার, সবই মিলছে খোলা বাজারের চেয়ে কম দামে, দুঃস্থ-গরিব শিশুদের সাহায্যার্থে। এতটাই মনে ধরেছে এই ভাবনা, যে জেলার আরও কিছু বিদ্যালয় এখন চেষ্টা করছে ন্যায্য মূল্যের দোকান খোলার।

ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অসীমকুমার অধিকারী জানান, "আমাদের বিদ্যালয়ে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে চালু হয় এই দোকান। এর বহুমুখী লাভ রয়েছে। একদিকে দুঃস্থ পড়ুয়ারা বাজারের চেয়ে অনেক কম মূল্যে যেমন পাঠনপাঠনের জিনিস পাচ্ছে, তেমনি ছোট থেকেই দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হচ্ছে গণিতের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে। শুধু তাই নয়, কেউ যদি কোনো কারণে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পয়সা না আনতে পারে, তাহলে বাকিরা নিজেদের কেনা খাতা কিংবা আর্ট পেপার ভাগ করে নিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে।"

publive-image অন্য স্কুলের কাছেও উদাহরণ তৈরি করছে এই উদ্যোগ

জেলায় তিন হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হওয়ায় শিশুদের পড়াশোনা সংক্রান্ত নানা সামগ্রী কিনতে অনেক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। সেই সমস্যা ঘোচাতেই এই অভিনব ভাবনা। মূলত টিফিনের সময় নিয়ম করে খোলা হয় এই দোকান। কচি হাতেই দিব্যি চলে বিকিকিনি। কিন্তু রয়েছে চরম নিয়ম শৃঙ্খলা।কচিকাঁচাদের নিয়ে গড়া হয়েছে শিশু সংসদ। তাদের মধ্যেই একজনকে 'সংস্কৃতি মন্ত্রী' নির্বাচিত করে ওই দোকান চালানোর দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃতীয় শ্রেণীর ছোট্ট সাইফুল শেখ বলে, "দারুন লাগছে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে, জিনিস ফুরিয়ে গেলে স্যারকে বলছি, তিনি আবার তা এনে দিচ্ছেন।"

শুধু সাইফুল নয়, তাকে সাহায্য করতে নিয়োগ করা হয়েছে তারই উৎসাহী খুদে সহপাঠী সবুজ বিশ্বাসকেও। আর যারা ওই দোকানের গ্রাহক, তাদের উৎসাহও নেহাৎ কম নয়। চতুর্থ শ্রেণীর মুর্শিদা খাতুন, মনীষা খাতুন, রাজীব সাহ, ফিরোজ শেখেরা এক গাল হেসে বলে, "আমাদের গ্রামে খাতা, পেন, রং পেনসিল, তুলি, আর্টপেপার, যাই কিনি না কেন, তার দাম প্রচুর, কিন্তু এই দোকানে আমরা প্রায় অর্ধেক দামেই ওই সব জিনিস পাই।"

আরও পড়ুন: ময়নাগুড়ির চা বাগানে নজিরবিহীনভাবে চা-কমলার যৌথ চাষ

এই কর্মকান্ডে দারুণ খুশি নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকার অভিভাবকেরাও। অভিভাবক সারিফা বিবি, আলম শেখেরা বলেন, "এই রকম কিছু যে স্কুলেও চালু হতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবি নি কোনদিন। এতে আর্থিক সাশ্রয় যেমন হচ্ছে, তেমনি ছোটদের হুট করে কিছু দরকার হলে বিদ্যালয়ের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছে।" শুনে অসীমবাবু মৃদু হেসে জানান, "আপাতত পিএফ থেকে ঋণ নিয়েই ছোট আকারে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। একদিন হয়ত এই ভাবনা বৃহদাকারে সব বিদ্যালয়েই ছড়িয়ে যাবে।"

আর তেমনটাই হচ্ছে। জেলার সত্য শিশু ভারতী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কুতুবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মত দুটি প্রান্তিক স্কুলও এই ব্যবস্থা সাড়া ফেলে দিয়েছে। কুতুবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহামুদুল হাসান বলেন, "এই ভাবনার প্রচুর উপকার রয়েছে। একদিকে যেমন কম দামে আমরা ওদের অল্প হলেও জিনিস হাতে তুলে দিচ্ছি, পাশাপাশি শিশুরা ছোট থেকেই হিসাবনিকাশ সংক্রান্ত, দলগত কাজের ধরন শিখতে পারছে, পোক্ত হচ্ছে অঙ্কের ধারণাও।"

আর যাদের জন্য এত ভাবনা, সেই তৌফিক, সেলিম, প্রিয়া এরা বলছে, "ভালো লাগে একটু একটু পড়ার ফাঁকে দোকানদারি করতে, তবে হিসেব ভুল হলেই স্যারের কাছে ছুটে যাই।"

Education Murshidabad
Advertisment