আক্ষরিক অর্থেই যেন 'শখের বাজার'। ছোট ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমজুড়ে এমনই সব শখের সংগ্রহের ছড়াছড়ি। আদ্যিকালের কলমদানী, দুধের বোতল। দেওয়ালে ঝোলানো পুরনো দিনের ল্যান্ডফোন, ফিল্মের পোস্টার। দুপুরের রোদ সাদা পর্দা ভেদ করে খেলা করছিল এসব সংগ্রহের উপর। সোফাই বসে ১৮৫৭ সালের 'দি ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ' এর পেপারের পাতা ওল্টা ছিলেন বছর পঁয়ষট্টির এক লোক। যেখানে ছাপানো রয়েছে সিপাহী বিদ্রোহের খবর। তাঁর পাশে ফাইল বন্দি এরকমই সব রকমারি তথ্যের পাণ্ডুলিপি। ভাঁজে ভাঁজে রাখা। সবই বহু বছরের পুরনো কাগজ। পাঁপড় ভাজার মতো মচমচে হয়ে গেছে। কিছু কিছু সবটা পড়া যায় না। সাবধানে না ধরলে ভেঙে যায়। পলিথিনের জ্যাকেট পরিয়ে পরম যত্নে রাখা এই বয়স্ক ভদ্রলোকের কাছে। ওনার নাম ফাল্গুনী দত্ত রায়। একটি বেসরকারি সংস্থার ডিজিএম ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিন কেটে যায় নিজের সংগৃহীত নথির তথ্যে জোগাড়ে।
কলকাতা শহরের মধ্যে আরেকটি হারিয়ে যাওয়া কলকাতা আছে। যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। যার অতীতের দলিলের উপরেই ভরসা করে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান-ভবিষ্যৎ। যে শহরের উত্থান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত ধরে, তার পরে ডালপালা বিস্তৃত করে ভৌগোলিক গুরুত্বের দিক থেকে ক্রমশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতার উৎসকেন্দ্র হয়ে ওঠা, সে শহরের মজ্জায় মজ্জায় ঔপনিবেশিক গন্ধ যে থাকবে এতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুরনো কলকাতার এসব গন্ধই হয়তো নিজের সংগ্রহে রেখেছেন ফাল্গুনী দত্ত রায়।
আরও পড়ুন- আদি থেকে আধুনিক, কলকাতার ‘ক্যামেরাম্যান’-এর জিম্মায় এক স্বর্ণালী ‘ইতিহাস’
শোভাবাজার রাজবাড়ির এরকমই একটি দলিল বের করে দেখানোর সময় ফাল্গুনী বাবু বলছিলেন, 'ভাগে ভাগে প্রায় ৭০ বছর ধরে নির্মিত শোভাবাজার রাজবাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৭৫০-এর দশকের মধ্যভাগে, এবং শেষ হয় ১৮৩০-এর দশকে। মুর এবং ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের ধাঁচে গড়া এই ভবনটিকে আজকের যুগে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ এই রাজবাড়ি নির্মাণের মূলে যিনি, সেই নবকৃষ্ণ দেব কিন্তু নিজেকে ব্রিটিশদের কাছে একরকম বিকিয়েই দিয়েছিলেন, কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে যেচে ঘনিষ্ঠতা করেছিলেন সম্পত্তি এবং অর্থের লোভে।' এর প্রমাণ দেখাতে গিয়ে তুলে ধরেন সে সময়েরই কিছু কাগজ। এরকম সময়ে দাঁড়িয়ে এমন এসব জলজ্যান্ত তথ্য অবাক করার মতন।
আরও পড়ুন- ‘তারার ছায়া’য় স্মৃতির সমাহার, অপূর্ব-কীর্তিতে চাগিয়ে উঠছে ইতিহাস-প্রেম
কলকাতার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবু সব রয়েছে কলকাতাতেই, শুধু খুঁজে নিতে হয়। এমনটাই হয়তো করছেন এই সংগ্রাহক। ফাল্গুনী বাবু যদিও নিজেকে সংগ্রাহক বলতে রাজি নন। কর্মসূত্রে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। পথে ও মহল্লায় হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাসের ধূসর পাতারা ওনার ঝুলিতে ধরা দিয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগণার ঘোষপুর নামের একটি গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে ফাল্গুনী বাবুর। সংগ্রহের নেশার শুরুটা এই গ্রাম থেকেই।
সংগ্রহ শুরুর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে অনেক মেলা হত। সেসব মেলায় বিভিন্ন ধরণের পুতুল থাকতো। এই পুতুল কেনা দিয়েই আমার সংগ্রহের শুরু। এছাড়া ছোট বেলায় আমার দাদুকে দেখেছি কখনও কোন খবরের কাগজের কাটিং রেখে দেওয়া বা কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখা নিজের কাছে যত্ন করে রাখা। নিজের অজান্তে এসব জিনিসের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এটা বুঝতে পেরেছিলাম, কোন জিনিস ফেলে দিওনা সব জিনিসই মূল্যবান।'
এই শহরে খুঁজলে সব কিছুই পাওয়া যায়। এরকমই একদিন শোভাবাজার রাজবাড়ির ফুটপাথে ঘুরতে ঘুরতে একটা এনামেলের গ্লাস খুঁজে পেয়েছিলেন ফাল্গুনী বাবু। সেই এনামেলের গ্লাসটিতে ছাপা ছিল তখনকার জুবলি সেলিব্রেশনের কুইন ভিক্টোরিয়ার ছবি। এই গ্লাসটি যখন তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তখন নিজেও জানতেন না এই গ্লাসটি এত মূল্যবান। ঘটনাচক্রে পরে একটি বই ঘেঁটে এর তথ্য জানতে পারেন। গ্লাসটির ইতিহাস আসলে, ব্রিটিশ রাজপরিবারে কোন অনুষ্ঠান উদযাপনে এই ধরণের স্মারক তৈরি হয়। এরকমই কোন অনুষ্ঠানের জন্যেই তৈরি হয়েছিল কুইন ভিক্টোরিয়া ছবি দেওয়া এই স্মারক। যা কলকাতার ফুটপাথেই পুরনো জিনিসের সঙ্গে পড়েছিল।
আরও পড়ুন- কলকাতার এই প্রবীণ সংগ্রহ করেন উনিশ শতকের অমূল্য সব ‘সুচ-সুতোর’ ভালোবাসা
সংগ্রহের নেপথ্যে এরকম সব ঘটনা নতুন কিছু নয়। সময়ের সাথে সাথে আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলি। সেই হারিয়ে ফেলা জিনিসগুলোই পরম যত্নে গুছিয়ে রাখছেন ফাল্গুনী দত্ত রায়। আজকের কলকাতা শহর তৈরির পিছনে যে গল্প তা যদি সংগৃহীত না থাকে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ইতিহাস জানতেই পারবে না। এসব ইতিহাসই একের পর সন তারিখ দিয়ে সব ফাইলে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখছেন কলকাতার এই অভিনব সংগ্রাহক।
শখের কোনও শেষ নেই। কিন্তু ফাল্গুনী দত্ত রায়ের ইতিহাস সংগ্রহের শখ এটা বেশ অভিনব এবং শিক্ষণীয় বটে। হলফ করে বলা যেতে পারে এই প্রজন্মের অনেকে ঊনবিংশ কলকাতা কিংবা ব্রিটিশ শাসনের সময়কালীন আইনি নথি কেমন তা জানে না, তখনকার সংবাদপত্র দেখতে কেমন ছিল তাও বলতে পারবে না। খবরের কাগজে সিধু কানুর কাঠ খোদাই ছবি এসব জিনিস সহজেই দেখিয়ে দেন ফাল্গুনীবাবু। কলকাতার বহু চর্চিত ''ব্ল্যাক হোল অফ ক্যালকাটা" কিংবা সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে তৎকালীন সময়ের প্রকাশিত খবর। অথবা ১৭২৬ সালের কলকাতায় যে মেয়র কোর্ট স্থাপিত হয় তার নথি, উইলিয়াম অফ বেঙ্গল স্থাপিত হয় ১৭৭৪ সালে এবং প্রধান বিচারপতি হন ইলিজা ইম্পে, তাঁর সই করা নথি সবই সংগ্রহ করে রেখেছেন ষাটোর্ধ মানুষটি।
আরও পড়ুন- পুতুল নাচের ইতিকথা, সংগৃহীত পুতুলেরা যেন নিজেদের গল্প বলছে
সংগৃহীত জিনিসের ভাণ্ডার দেখতে দেখতে অতীত যেন চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়। ফাল্গুনী দত্ত রায় ইতিহাসের নথি ওলটাতে ওলটাতে বলে যান, 'বয়স হচ্ছে যত এসব জিনিসই আঁকড়ে ধরছি বেশী। যখন যা কিছু খুঁজে পাচ্ছি তা থেকে রসদ বের করে তথ্য সব লিখে রাখছি। এসবের জন্যেই মস্তিষ্ক সতেজ রয়েছে এখনও। এসব অতীতের জিনিস নিয়েই দিব্যি ভালো আছি।'