scorecardresearch

নববর্ষের আগেই চৈত্রের গরমে কোথায় হারিয়ে গেল বাংলার তালপাতার পাখারা!

কালের বিবর্তনে যেন হারিয়ে যেতে বসেছে তালপাতার পাখা।

fans made of palm leaves are going to be lost in the evolution of the era
তালপাতার পাখা তৈরির ব্যস্ততা। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

ছোটবেলার লন্ঠণ, কুপি, শুকতারা, সাপলুডো, হাতপাখা। বিকেলবেলায় খেলতে যাওয়া, সন্ধ্যে হলে পড়তে বসা। লোডশেডিং হলেই আনন্দের শেষ নেই। আলো নিভলেই মাদুর নিয়ে পুরো পরিবার সোজা ছাদে। একটা লন্ঠন, হাতে হাতপাখা নিয়ে গল্প শুরু। এসব হারিয়ে গিয়েছে। লোডশেডিংয়ের সেই দাপট আর নেই। বাড়িতে লন্ঠন এখন শো পিস। ঘরের ক্যালেন্ডার জানান দিচ্ছে আর হপ্তাখানেক বাদেই বাংলা নববর্ষের। চৈত্র মাসের গরম সামাল দিচ্ছে এসির হাওয়া। বৈশাখের আগে হাত পাখার শনশন হাওয়া এখন কারো গায়ে লাগে না। তালপাতার পাখারা নাম লিখিয়েছে নস্ট্যালজিয়ার দলে। তবে একটা সময় ছিল যখন বাংলার নতুন বছরে ঘরে নিয়ে আসা হত রঙ বেরঙের হাতপাখা।

“শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমের পাখা” এই ছিল বাঙালির চিরকালের সম্বল। সেই কোন গ্রিক রোমান সভ্যতার যুগ থেকে চলে আসছে হাত পাখার ব্যবহার। যারা নব্বই দশক কিংবা তারও আগে বেড়ে উঠেছেন, তারা জানেন ঠাকুমারা হাতপাখার হাওয়া খেতে খেতে ঝুলি থেকে বের করতো একের পর এক গল্প। অতীতের এসব স্মৃতিতে পড়েছে ধুলোর আস্তরণ। এসি আর এয়ার কুলারের যুগে কে বা রাখে হাতপাখার কদর। তালপাতার পাখারা এখন লুপ্তপ্রায়।

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

তবে এখনও কিছু কিছু গ্রাম এসব তালপাতার পাখার মতন কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যেমন ডায়মন্ড হারবার লাইনের দেওলা গ্রাম পঞ্চায়তের নাজরার শেখপাড়া কিংবা ফকিরপাড়া। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার লোকের কাছে ‘তালপাখার গ্রাম’ নামে বেশি পরিচিত। বংশ পরম্পরায় এখানে সকলে হাতপাখা বানানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত। সকালে মাঠেঘাটে চাষবাস করা শেষ করে বিকেল হলে বউ বাচ্চা নিয়ে ঘরের দাওয়ায় কিংবা উঠানে বসে এখনও পাখা বোনেন।

কার্তিক মাসে শীত শীত ভাব আসতেই তালপাতা কাটা শুরু হয়। সেই পাতা ভিজিয়ে, শুকিয়ে, সেলাই ও রং করে তৈরি করা হয় পাখা। যে পরিমাণ খাটনি হয় সেই অনুযায়ী দাম মেলে কই? চৈত্র থেকে বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য এই তিন মাস হাতপাখারা বাজার। কিন্তু আগের চেয়ে চাহিদা ক্রমশ কমে যাওয়ায় এখন উৎপাদন কমেছে। গ্রামের নতুন প্রজন্মের কেউ পেশায় আসেনি। তার জন্যে কমেছে পাখাশিল্পীও। বেশিরভাগই চলে গিয়েছেন ভিন্ন পেশায়।

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

যে দু’একজন শিল্পী রয়েছেন তাঁরাই কোনওরকমে বংশানুক্রমে চলে আসা এই ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সব শিল্পীরা জানালেন, একে বাজার কমে গিয়েছে। তার উপর কমে যাচ্ছে তালগাছ। গাছ কেটে নেওয়ার জন্য মিলছে না তালপাতা। তার উপর তালগাছ থেকে পাতা কাটার জন্য শ্রমিক আগের মতো মিলছে না। তালপাতার দামও আগের তুলনায় বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে পাখার দামও। অনেকেই এখন তালপাতার পাখার বদলে প্লাস্টিকের তৈরি পাখা ব্যবহার করছেন। সব মিলিয়ে পাখা শিল্পের করুণ অবস্থা বলে জানালেন শেখপাড়ার পাখাশিল্পী রহিস আলি শেখ।

আরও পড়ুন- থমথমে রিষড়ায় রাজ্যপাল, বন্ধ দোকানপাট, স্থানীয়দের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট

রহিস আলি শেখের কথায়, “বাবার হাত ধরে এই ব্যবসায় এসেছিলাম। বয়স আট নয় বছর হবে। এখন আর পাখার সেই সুদিন নেই। তবু বাপ-ঠাকুরদার ব্যবসা বলে কোওরকমে টিকিয়ে রেখেছি। বেশীরভাগই তো চলে গিয়েছে। গ্রামের কুটির শিল্পীদের কেউ দেখার নেই। সরকার থেকে কোনোরকম সাহায্যে পাওয়া যায়না। গ্রামের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব খারাপ। এভাবে কি আর কিছু টিকিয়ে রাখা যায়!” তিনি জানান, গোটা গ্রামে এখন পাখাশিল্পী হাতে গোনা নয় দশজন।

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

গ্রামেরই আরেক পাখাশিল্পী হান্নান শেখ জানান, একটা বড়গাছের তালপাতায় দু’টি পাখা তৈরি হয়। ছোট চারাগাছের পাতায় একটি হাতপাখা হয়। ভাল মানের হলে পাখার দাম পড়ে ২৫ টাকা। সাধারণ তালপাতার পাখা ১৩ টাকা পড়ে। সারাদিনে ২০ থেকে ২৫টি পর্যন্ত পাখা তৈরি করেন। তবে বাজারে কম পয়সার প্লাস্টিক পাখার প্রচলন বাড়ায় তালপাতার পাখা তৈরির সঙ্গে মাঝে মাঝে প্লাস্টিকের পাখাও তৈরি করছেন হান্নান শেখ। তাঁর কথায়, “কী করব, সংসার চালাতে হবে তো! যখন যা কাজ পায় করতে থাকি।”

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

সাধারণত এই হাতপাখা তৈরি হয় দুই-তিন ধাপে। তালগাছের পাতা কাটা, তাকে জলে ডুবিয়ে রেখে জাঁক দিয়ে পাতাকে সোজা করা হয়। তারপর সেই পাতাকে সাইজ করে কাটা, সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বাঁধা, রং করা ইত্যাদি নানা পর্বের মধ্য দিয়ে পাখা রেডি হলে তার বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। একটা তালপাতা থেকে একটা বা দুটো পাখা তৈরি হয়।

আরও পড়ুন- রিষড়ায় অশান্তি: ফের পুলিশি বাধায় রেগে কাঁই সুকান্ত! ধুয়ে দিলেন মমতাকে

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

চৈত্র মাস থেকে চলত তালপাতার পাখা তৈরি ও বিক্রির ধুম। বর্তমানে ঘরে-ঘরে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার আর তা না হলে প্লাষ্টিকের তৈরি হাতপাখার প্রচলন। তালপাখার ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ঐতিহ্যের তালপাতার পাখা আজ শুধুই স্মৃতি। তালগাছের পাতায় বাসা তৈরি করা বাবুই পাখির সেই কিচির-মিচির আর শোনা যায়না।

এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।

পয়লা বৈশাখের আগে বাংলার নববর্ষের চেনা ছবিগুলো বদলে গিয়েছে। বাড়ির বউরা কাসার থালায় ভাত বেড়ে দিয়ে তালপাতার পাখায় হাওয়া করতে বসে না। মাথার উপর দিন রাত বনবন করে ঘুরছে পাখা। কোনও গ্রামের বটতলা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো স্মৃতি। গোল হয়ে বসে কয়েকজন বৃদ্ধ হয়তো এখানেই বসেই হাতপাখায় হাওয়া খেত। ভীষণ গরমে হঠাৎ লোডশেডিং হলে মায়ের কোলে শুয়ে তালপাখার হাওয়ারা যেন শরীর জুড়িয়ে দিত।

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Westbengal news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Fans made of palm leaves are going to be lost in the evolution of the era