মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায় নিজের অফিসে বসেই কাজ করেছিলেন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও)। হঠাৎই একটি মেয়ে তাঁর কাছে ছুটে আসেন। একটাই আর্তি গলায়, 'স্যর, দয়া করে আমাকে বাঁচান'। হতভম্ব বিডিও! জানতে পারলেন নিজের বাড়ি থেকে ১১ কিলোমিটার পথ পালিয়ে এসেছেন মেয়েটি। কারণ বয়সের আগেই বাড়ি থেকে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছে পরিবার। তাই বাঁচতে চেয়ে এভাবে পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর।
তবে এই ঘটনা শুধু মুর্শিদাবাদের নয়, লকডাউন বাংলায় বিভিন্ন জেলায় জেলায় অনেক জায়গা থেকেই উঠে আসছে নারীপাচার এবং বাল্যবিবাহের মতো অভিযোগ। করোনা-আমফানে বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক জীবন ফের মহিলাদের জীবনে ডেকে আনছে ভয়াবহতা। উল্লেখযোগ্যভাবে লকডাউনের প্রথম মাস থেকেই নাবালিকাদের জোর করে বিয়ের দেওয়ার মতো ঘটনা প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে গিয়েছে। তবে এই বৃদ্ধি আশঙ্কার মেঘ জমাচ্ছে সমাজের সব মহলেই।
সংখ্যার হিসেবেই তাই ভয় বাড়ছে বাংলার। মার্চের ২৩ তারিখ থেকে এপ্রিলের ২৩ তারিখ পর্যন্ত রাজ্য শিশু অধিকার সংরক্ষণ কমিশন (এসসিপিসিআর)-এ জমা পড়েছে ১৩৬টি অভিযোগ। বাল্যবিবাহ নিয়ে দিনে গড়ে প্রায় চারটি করে অভিযোগ এসেছে কমিশনে। সবচেয়ে বেশি এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগণা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে। আগে যেখানে মাসে ৫০টি অভিযোগ আসত সেখানে এই মাসে সেই সংখ্যা দ্বিগূণেরও বেশি। সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কমিশনের আধিকারিকরা। কিন্তু কেন এই বাড়বাড়ন্ত? কমিশনের আধিকারিকদের তরফে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলা হয় যে লকডাউনের কারণে বহু পরিবার আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন। দারিদ্র্যের সব রোষ পড়েছে মেয়েদের উপরেই। তাই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পরিবারগুলি।
লকডাউন বাংলা যেন সেই সমাজকেই নিয়ে আসল, যেখানে মেয়েরা আজও প্রান্তিক। দু-মুঠো অন্নের চেয়ে পরের বাড়ি পাঠানো বোঝা হ্রাস। ওয়াকিবহাল মহলের মত, লকডাউনে বিয়ের খরচ কমে যাওয়ায় দারিদ্রসীমার নীচে থাকা অনেকেই এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এসসিপিসিআর-এর চেয়ারপার্সন অন্যন্যা চক্রবর্তী বলেন, "এর মতো দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। এই মুহুর্তে স্কুলও বন্ধ। প্রশাসন লকডাউন নিয়ে ব্যস্ত। তাই চোখ এড়ানো সুবিধে পরিবারের পক্ষে। কিন্তু আমরা নজর রাখছি সবরকমভাবে। চেষ্টা করছি তথ্য নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার।"
তবে কি লকডাউনই কারণ এই মানসকিতার নেপথ্যে? কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের নোডাল অফিসের প্রধান সন্দীপ মিত্রের কথায়, "অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে একজনের জন্য দু'বেলা খাবার বরাদ্দ বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গিয়েছে। তাঁদের পরিবারে আরও অনেক বাচ্চা আছে। অর্থনৈতিক কারণেই এই মানসিকতা এসে গিয়েছে।" তিনি বলেন, "আমাদের দলের লোকেরা চেষ্টা করছে তাঁদের বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে। কাউন্সেলিংও চলছে। চেষ্টা করা হচ্ছে খাবারের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার।"
আড়াই ঘন্টা পথ পেরিয়ে বিডিও অফিসে আসা মুর্শিদাবাদের মেয়েটির জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন বিডিও পূর্ণেন্দু স্যানাল। তিনি জানান যে মেয়েটির পরিবারে সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বিষয়টি বোঝান। আপাতত পরিবারটির দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি। পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, "মেয়েটির পরিবার খুবই দুঃস্থ। ঘরে দুই ভাই আছে। বাবা মাঠে কাজ করেন। গত বছরেও মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। লকডাউনে সেই সুযোগ এসেছিল। কিন্তু মেয়েটির সাহসীকতা সব বিঘ্নকে জয় করল আজ।"
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন