Advertisment

স্বার্থভরা দুনিয়ায় নিঃস্বার্থ উদ্যোগ, শিক্ষকহীন স্কুলে বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান পাঁচ শিক্ষিত বেকারের

হুঁশ নেই প্রশাসনের, তবে জেলাশাসকের তরফে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস মিলেছে।

IE Bangla Web Desk এবং Rajit Das
New Update
Five educated unemployed youths teaching without salary in Basantpur Junior High School of Jamalpur Burdwan , স্বার্থভরা দুনিয়ায় নিঃস্বার্থ উদ্যোগ, শিক্ষকহীন স্কুলে বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান পাঁচ শিক্ষিত বেকারের

একেবারে ডানদিকে অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ ও বাকি পাঁচজন শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী।

বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে বিস্তর গোলোযোগ। নিয়োগ দুর্নীতি তো রয়েইছে, তার সঙ্গেই কখনও কখনও অবার শিক্ষকের আকাল নিয়ে শরগরম হয়েছে রাজনীতি। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের বসন্তপুর জুনিয়ার হাই স্কুল। শিক্ষকের আকালে ধুঁকছে। প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই অবস্থায় ওই স্কুলের হাল ধরেছেন পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষা দরদি স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বেতনের প্রত্যাশা না করে শুধুমাত্র এলাকার পড়ুয়াদের মুখ চেয়ে ওই পাঁচ শিক্ষিত বেকার সরকারি স্কুলে পড়িয়ে যাচ্ছেন। মহতি এই কর্মকাণ্ডকে প্রতিনিয়ত এলাকাবাসী কুর্ণিশ জানাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন সম্ভব?

Advertisment

জামালপুরের পাড়াতল ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম বসন্তপুর। একদা এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা লাভের ভরসা বলতে ছিল শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক স্কুল। আশপাশে কোনও জুনিয়র হাই স্কুল ছিল না। তাই লেখাপড়ার জন্য বসন্তপুর ও তার সংলগ্ন বেত্রাগড়, সজিপুর প্রভৃতি গ্রামের ছেলে মেয়েদের পাঁচ কিলোমিটার দূরে জামালপুর বা সেলিমাবাদ হাই স্কুলে যেতে হত। এই দূরত্বই স্কুল বিমুখ করে তুলছিল এলাকার দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলে মেয়েদের। বিষয়টি নিয়ে বসন্তপুর গ্রামের অনেকেই চিন্তায় পড়েছিলেন। এলাকায় একটা স্কুলের জন্য নানা জায়গায় দরবার করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত গ্রামের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার স্বার্থে একটি জুনিয়র হাই স্কুল গড়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নেন স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ। যা অবশ্য এখন শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হওয়ার পথে।

এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, '২০১০ সালের প্রথম থেকে লড়াই শুরু করেছিলাম। এই ব্যাপারে গ্রামের মানুষজন এবং তদানিন্তন জামালপুর ব্লকের স্কুল পরিদর্শক (এসআই) সমরেশ দাসের প্রভূত সহযোগীতা পেয়েছি। ওই বছরের জুন মাসে শিক্ষা দফতর থেকে বসন্তপুর গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার সবুজ সংকেত মেলে। স্কুলের একটি ঘর তৈরির জন্য ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকাও অনুমোদন হয়ে যায়। কিন্তু অনুমোদনের নথিতে ত্রুটি থাকায় প্রস্তাব ফেরৎ চলে যায়। এরপর থেকে স্কুল ঘর তৈরি নিয়ে টালবাহানা চলতেই থাকে। এমনকী স্কুলের জন্য জমি পাওয়া নিয়েও চুড়ান্ত জটিলতা তৈরি হয়। তবুও হাল ছাড়িনি। শেষমেষ স্কুল তৈরির জন্য সরকারের তরফে বসন্তপুর গ্রামে দুই বিঘার মত জমি বরাদ্দ করা হয়। তারপর পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ওই জমির তথ্য উল্লেখ করে সেখানে স্কুল তৈরির অনুমোদন দেয়। পূর্বে পাওয়া ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকায় ওই বছরেরই শেষের দিকে স্কুল ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়। ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য চারজন গেস্ট টিচারও মেলে। এখন স্কুলের ১৩৯ জন পড়ুয়ার মিডডে মিল রান্নার ঘর ছাড়াও টিচার্স রুম সহ পাঁচটি ঘর রয়েছে। এছাড়াও অপর একটি ঘরের নির্মান কাজ চলছে।'

publive-image
বসন্তপুর জুনিয়ার হাই স্কুল।

এত কিছুর পরেও স্বস্তিতে নেই বসন্তপুর জুনিয়র হাই স্কুলের পড়ুয়া, অভিভাবক ও এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন। তাঁরা এখন ওই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। এমন আশঙ্কা তৈরির কারণটাও যথেষ্ট চমকে দেওয়ার মতই!

এ প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, 'আমাদের স্কুলের জন্য ২০১৮ সালে তিনজন স্থায়ী শিক্ষক অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এখনও পর্যন্ত স্কুলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই। অতিথি শিক্ষকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। এখন গোটা স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন অতিথি শিক্ষক। তাঁর একার পক্ষে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের পঠন পাঠনের দায়ভার সামলানো সম্ভব নয়। শিক্ষকের আকালের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই অবস্থায় স্কুলে তালা পড়া আটকাতে বেতনের প্রত্যাশা না করেই পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী এগিয়ে এসেছেন। পড়ুয়াদের পাঠদানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ওই বেকারদের মধ্যে সুমন মাঝি ও স্বাগতা ঘোষ বাংলায় এমএ। শিল্পা সাহা ভূগোল ও সহেলি মণ্ডল ইতিহাসে এমএ পাস করেছেন। আর বিশ্বজিৎ মিত্র বিএসসি পাস। এদের কয়েক জনের আবার বিএড কোর্সও সম্পূর্ণ করা রয়েছে। নিঃস্বার্থে এই শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই এখনও স্কুলটি টিকিয়ে রাখা গিয়েছে। তবে স্থায়ী শিক্ষক ছাড়া এইভাবে আর কতদিন স্কুলটি চালানো সম্ভব হবে তা জানি না।'

publive-image
ক্লাসে পড়াচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ।

অভিভাবক অরিজিত মণ্ডল আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, 'শুধু স্থায়ী শিক্ষকের আকালে আমাদের গ্রামের স্কুলটি ভুগছে এমনটা নয়। স্কুলের জমি নিয়েও জটিলতা রয়েছে।' য়া নিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথবাবু বলেন, '২০১৪ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও সরকার থেকে পাওয়া জমি স্কুলের নামে রেকর্ড ভুক্ত হয়নি। এর জন্য বিকাশভবনের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের গাফিলতিকেই দায়ী।' তিনি বলেন, 'কোভিড পরিস্থিতির আগে স্কুলের জমি সংক্রান্ত এনকোয়ারি শেষ করে রেকমেন্ডেশনের জন্য কমিশনার অফ ল্যাণ্ড রিফর্ম ডিপার্টমেন্ট তথ্য সহ ফাইল নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠায়। সেই রেকমেন্ডেশন যাচাইয়ের জন্য নবান্ন থেকে ওই ফাইল বিকাশ ভবনে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিকাশ ভবনের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে এই ব্যাপারে কোনও হেলদোল দেখাচ্ছে না। ফাইল হারিয়ে গিয়েছে বলে মৌখিক ভাবে জানিয়েই পাশ কাটাচ্ছেন বিকাশ ভবনের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের কর্তারা।'

এদিকে বসন্তপুর গ্রামের স্কুলের এমন দুরাবস্থার কথা জেনে জামালপুরের প্রাক্তন বাম বিধায়ক সমর হাজরা কটাক্ষ করতে ছাড়েননি । তিনি বলেন, 'তৃণমূল সরকারের রাজত্বে বাংলার স্কুলগুলির ভবিতব্য এটাই হতে যাচ্ছে।' যদিও জেলা শাসক পূর্ণেন্দু মাঝি বলেন, 'স্কুল বাঁচাতে পড়ুয়াদের পাঁচ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীর নিঃস্বার্থে পাঠদানের বিষয়টিকে কুর্ণিশ জানাই। স্কুলে স্থায়ী পদে একজনও শিক্ষক না থাকা এবং স্কুলের জমি নিয়ে যে সমস্যা এখনও রয়ে আছে সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেলে আমি সমস্যা সমাধানে যাথাসাধ্য চেষ্টা করবো।'

একই ভাবে জামালপুরের তৃণমূল বিধায়ক অলক মাঝি স্কুলটির যাবতীয় সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

East Burdwan burdwan West Bengal TEACHERS
Advertisment