Advertisment

যে আন্দোলন জন্ম দেয় 'জুনিয়র ডাক্তার'দের

১৯৮০ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ এবং আর জি করে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করলেন হাউজ স্টাফ ও ইন্টার্নরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনার প্রেক্ষিতে ডাক্তারি পড়ুয়াদের আন্দোলনের জেরে এখন উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজেই ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা পরিষেবা। স্বাস্থ্য মহলের একাংশের মতে, জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন ফিরিয়ে এনেছে সাড়ে তিন দশকের পুরনো চিকিৎসক আন্দোলনের স্মৃতি। আটের দশকের ওই আন্দোলনের জেরে কার্যত কেঁপে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থা। বস্তুত, 'জুনিয়র ডাক্তার' শব্দবন্ধটি ওই আন্দোলনেরই অবদান।

Advertisment

কেমন ছিল ডাক্তারি পড়ুয়াদের ওই আন্দোলন?

সময়টা আটের দশকের শুরু। রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর পাশাপাশি শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে নকশালপন্থীদের। কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ এবং এসইউসিআই-এর ডিএসও-র সংগঠনও জোরদার। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ মাথাচাড়া দিচ্ছিল ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে।

১৯৭৯-৮০ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ এবং আর জি করে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করলেন হাউজ স্টাফ ও ইন্টার্নরা। এই আন্দোলন পরিচিত হল হসপিটাল মুভমেন্ট নামে। পরবর্তী বছরগুলিতে ক্রমশ সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল এন আর এস, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, এস এস কে এম-সহ কলকাতার প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্দোলন পৌঁছে গেল জেলাতেও। রাজ্যের সবকটি মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা মিটিং, মিছিল, ধর্না, প্রিন্সিপালের দফতর ঘেরাও শুরু করলেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে তৈরি হল হাউজস্টাফ-ইন্টার্ন অ্যাসোসিয়েশন (এইচআইএ) এবং জুনিয়র ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (জেডিএ)।

আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল:

প্রতিটি হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা এক্স-রে, ইসিজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথোলজি এবং ব্লাড ব্যাঙ্ক চালু করতে হবে

বেডের সংখ্যা বাড়াতে হবে

হাসপাতালের কর্মী সংখ্যা বাড়াতে হবে

হাউজ স্টাফ ও ইন্টার্নদের ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে

আরও পড়ুন, ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে এবার পাকিস্তান

মূলত এই দাবিগুলিকে কেন্দ্র করেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয় ডাক্তারি পড়ুয়াদের আন্দোলন। সেই সঙ্গে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজের নিজস্ব কিছু দাবিদাওয়াও ছিল। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের হাউজস্টাফ এবং ইন্টার্নদের সংগঠনগুলিকে এক ছাত্র তলায় এনে গঠিত হল আন্দোলনের মঞ্চ অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফেডারেশন (এবিজেডিএফ)। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে হল সংগঠনের প্রথম কনভেনশন। সরকারের কাছে দাবিপত্র পেশ করা হল। কিন্তু সরকার সংগঠনকে মান্যতা দিতেই চাইল না।

শুরুর সময় সংগঠনের সভাপতি ছিলেন দেবাশিস দত্ত। দেবাশিসবাবু এখনও স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমানে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) দলের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সংগঠক পুণ্যব্রত গুন, জয়ন্ত ভট্টাচার্যেরা। এসইউসিআই নেতা তথা জয়নগরের প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডলও ছিলেন সামনের সারির সংগঠক।

পূ্ণ্যব্রবাবু জানান, ১৯৮৩ সালের ২৩ মার্চ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কনভেনশন করে এবিজেডিএফ। দাবির সমর্থনে হাসপাতালের আউটডোরের প্রচার চলল, করা হল ৬৭টি পথসভা। ২২ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। তিনি আশ্বাস দিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সাতদিন পেরিয়ে গেল, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আলোচনায় বসলেন না। এরপর ৯ থেকে ১৪ মে বিভিন্ন হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে আউটডোর বয়কট করা হয়। ব্যাজ পরে পালিত হয় দাবি দিবস। ১৩ জুন থেকে শুরু হয় আউটডোর, ইনডোর বয়কট এবং একটানা দু-দিন অনশন। ১৫ জুন সর্বত্র আউটডোর, ইনডোর, এমারজেন্সি বয়কট করে হাসপাতালগুলিকে অচল করে দেন জুনিয়র ডাক্তাররা। প্রবল চাপে পড়ে রাজ্য সরকার। রোগীদের স্বার্থে আন্দোলনকারীরা চালু করেন প্যারালাল ইমারজেন্সি স্কোয়াড। এই পর্যায়ে একাধিকবার শাসকদল ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের।

১৭ই জুন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনা হল দাবীদাওয়া নিয়ে। ৭ই জুলাই সরকার জুনিয়র ডাক্তারদের ভাতাবৃদ্ধির ঘোষণা করল। কিন্তু অন্যান্য দাবিগুলি সম্পর্কে নীরব থাকায় আন্দোলন অব্যাহত রইল। ৯ থেকে ১৩ জুলাই আউটডোর বয়কট করে জুনিয়র ডাক্তাররা প্যারালেল আউটডোর চালালেন। পূন্যব্রবাবুর কথায়,  "আন্দোলনের মঞ্চ থেকে প্রস্তাব এল, বাড়তি ভাতা রোগীদের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে। ৪ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আবার আলোচনা হল, কিন্তু কোনও সমাধানসূত্র বেরল না।  ৫ থেকে ১২ আগস্ট আবার কর্মবিরিতির পথে গেলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এরপর ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর জনস্বার্থ-সম্পর্কিত দাবিগুলো নিয়ে পালাক্রমে আউটডোর বয়কট করা হল।"

আন্দোলনের এই পর্যায়ে সরকার আরও তীব্র বিরোধিতার পথে গেল। ২০ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী বললেন, "ওরা প্রত্যেকের চাকরির দাবি করছে। আমরা আগেই বলে দিয়েছি, সবার চাকরির ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।" রাজ্য সরকার জানাল, সমান্তরাল আউটডোর চালানো কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণার নামান্তর। আরও তীব্র হল সংঘাত।

২১শে থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর পূর্ণ কর্মবিরতির পথে গেলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এর পাল্টা পয়লা অক্টোবর সরকার ঘোষণা করল,  ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী জুনিয়র ডাক্তারদের কমপ্লিশন সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। তৎকালীন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের নেতৃত্বের অভিযোগ, ৪ অক্টোবর এস এস কে এম ও নীলরতন সরকার মেডিকাল কলেজ হাসপাতালেঅবস্থানরত জুনিয়র ডাক্তারদের উপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ন্যাশানাল মেডিকাল কলেজে হামলার অভিযোগ ওঠে সিপিএমপন্থী কোঅর্ডিনেশন কমিটির বিরুদ্ধে। এরপর আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়ে।

৫ অক্টোবর মধ্যরাত্রে রাজভবনের সামনে অবস্থান শুরু করেন কয়েকশো ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মী। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সবকটি হাসপাতাল। ৬ অক্টোবর ১৮টি সরকারি হাসপাতালে ইন্ডোর বাদে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়। ৮-১০ অক্টোবর বিভিন্ন হাসপাতালে শাসকদলের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। ১৩ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে আলোচনাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তৎকালীন ডিএসও নেতা, পরবর্তীতে এসইউসির সাংসদ তরুণ মন্ডল। বাকিরা আলোচনা চালিয়ে গেলেও সদর্থক ফল মিলল না।

দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অবশেষে ১৩ অক্টোবর খানিকটা পিছু হটল সরকার। আন্দোলনকারীদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হল।  আরও বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া হল। ১৪ অক্টোবর আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।

সংক্ষেপে, এই হল আটের দশকের জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের ইতিহাস।

তৎকালীন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের নকশালপন্থী ছাত্রনেতা পার্থ ঘোষ এখন সিপিআইএমএল লিবারেশনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। তাঁর অভিযোগ, আন্দোলন ভাঙতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এবিজেডিএফের পাল্টা জেডিসি নামে জুনিয়র ডাক্তারদের একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সরকারি ডাক্তারদের একমাত্র সংগঠন এইচএসএ ভেঙে সিপিএমের উদ্যোগে নতুন সংগঠন এএইচএসডি তৈরি হয়।

পার্থবাবু বলেন, "এন আর এস-সহ বেশ কিছু কলেজে পুলিশ ও শাসকদলের ক্যাডারদের হামলার মোকাবিলা করেছিলাম আমরা। আন্দোলনের নেতৃত্বের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল শাসকদলের সমর্থকেরা। নাগরিক কমিটির নামেও হামলা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন দমন করা যায় নি। বস্তুত, এর আগে জুনিয়র ডাক্তার শব্দবন্ধটি প্রচলিত ছিল না। আমরাই প্রথম সংগঠনের নামে 'জুনিয়র ডাক্তার' শব্দ দুটি ব্যবহার করি। তারপর থেকেই এর ব্যবহার সর্বত্র।"

আন্দোলনের আরেক নেতা জয়ন্ত ভট্টাচার্যের কথায়, "রোগীর পরিবার ও চিকিৎসকদের মধ্যে একটি সেতু গড়ে তুলতে পেরেছিলাম আমরা। ডাক্তার আর রোগী যে পরস্পরবিরোধী শক্তি নয়, সেটা খানিকটা সামনে আনা গিয়েছিল।" আটের দশকের আন্দোলনের কর্মী-সংগঠকদের অনেকেই পরবর্তীকালে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। শহীদ হাসপাতাল, শ্রমজীবী হাসপাতাল, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সেই সময়ের এবিজেডিএফের নেতাকর্মীরা।

আরও পড়ুন, দেশব্যাপী আন্দোলনের হুঁশিয়ারি, মমতাকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিল এইমস

বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার এবং তাঁর স্বামী তথা তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা সুদর্শন ঘোষদস্তিদারও ওই সময়েই ডাক্তারি পড়তেন। দুজনেই ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাকলি বলেন, "সেই সময়ের আন্দোলনের নেতৃত্বে মূলত নকশালপন্থীরাই ছিলেন। তবে এন আর এসে যা হচ্ছে, তার সঙ্গে আটের দশকের জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের কোনও মিল নেই।" তৎকালীন জুনিয়র ডাক্তাদের দাবি, বাম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও তাতে যোগ দেন নি ছাত্র পরিষদ নেতৃত্ব। মূলত সরকার-বিরোধী বামপন্থী পড়ুয়ারাই ছিলেন প্রধান সংগঠকের ভূমিকায়।

পার্থবাবু বলেন, "এতদিন পরে ফিরে তাকালে মনে হয়, ওই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল একটি বিকল্প সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। আগে রীতি ছিল, গাইনি বিভাগে কোনও মা সন্তানের জন্ম দিলে রিলিজের সময় পরিবারটি মিষ্টি দিয়ে যাবে। একদিক থেকে দেখলে এতে কোনও দোষ নেই, খুবই সুন্দর বিষয়। কিন্তু আমাদের গরীব দেশের অসংখ্য পরিবারের পক্ষে এত বোঝা বহন করা অত্যন্ত কষ্টের। অথচ, তাঁরা দিতে বাধ্য হতেন। আমরা এই ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।"

NRS doctors day
Advertisment