কথায় বলে, বাঙালি সব ছাড়া থাকতে পারে কিন্তু রাস্তার ধারে চৌকো একটা বক্স, তার সঙ্গে তেঁতুল জলের একটা হাঁড়ি, এই দৃশ্য দেখলে তাঁরা নিজেকে সামলাতে পারে না। কারণ, আপামর বাঙালির মন জুড়ে যে খাবারের বাস, তাকে এককথায় ফুচকা বলে। যদিও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়, ছেলেদের ফুচকা বেশি পছন্দ নাকি মেয়েদের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এমন এক জায়গায় নাম শুনেছেন যেখানে হাত বাড়ালেই শুধু ফুচকা?
অবাক হচ্ছেন শুনে? যদিও এই বাংলার কোথায় কোথায় কী কী ছড়িয়ে আছে সেটা অনেকেরই অজানা। উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্দরে এরকম একটি জায়গার খোঁজ পেয়ে যাবেন আপনিও। কাঁচরাপাড়া - যেটি বিখ্যাত রেল ওয়ার্কশপ হিসেবে, সেখানেই যে শুধু ফুচকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ঐতিহাসিক জায়গা, সেই সম্পর্কে জানা আছে? জায়গাটি ইতিহাসের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে তেমনই ফুচকার সঙ্গে এর সম্পর্ক একদম অন্যরকম। রাসমণি ঘাটের সংলগ্ন এলাকায়, শহিদ পল্লি যেন ফুচকার স্বর্গ।
ভুল করেও কিন্তু শহিদ গ্রামে চলে যাবেন না। ফুচকা পাড়া নামে খ্যাত এই জায়গায় হাত বাড়ালেই শুধু ফুচকা আর ফুচকা। ফুচকার বিভিন্ন আইটেমের ছড়াছড়ি। কী নেই? চকোলেট ফুচকা, ঘুগনি ফুচকা, চিকেন ফুচকা ছাড়াও এখানে সবথেকে আকর্ষণীয় যে ফুচকা সেটি হল লোটে ফুচকা, চিংড়ি ফুচকা। যদিও তাঁরা এই জায়গাকে ফুচকা পাড়া কিংবা ফুচকা গ্রাম বলতে নারাজ।
/শহিদ পল্লির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের হাজারো স্মৃতি। তাই, কেউ যখন হঠাৎ করেই এই নামটি বলেন, তখন যেন তাঁদের মনেও প্রভাব পড়ে, কেউ কেউ তো ভীষণমাত্রায় রেগেও যান। তাই শুদ্ধ বাংলায় এখনও তাঁরা শহিদ পল্লির মানুষ। যাঁরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন ফুচকা বানানো এবং বিক্রির পেশাকে। গোটা এলাকায় যেন ফুচকা ছাড়া আর কিছুই নেই। সকাল থেকে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় সেখানে। ভোর থেকে লেচি বানিয়ে তারপর ফুচকা ভাজা, তারপর একে একে সমস্ত কাজ সেরে নিয়ে বেলা তিনটা গড়াতেই ফুচকা নিয়ে নিজেদের বাড়ির সামনে বিক্রির জন্য বসে পড়া।
এখানের ফুচকা বিক্রেতা রঞ্জিত বালা, কিংবা সুজাতা পালের তরফে জানা গেছে বেশ কিছু তথ্য। দীর্ঘ ২০-২৫ বছর ধরে তাঁরা এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। ফুচকার প্রতি তাঁদের ভালবাসা দেখার মত। নিজেদের চেষ্টায় বানিয়েছেন কত রকমের ফুচকা। সারাদিনে কেউ বানাচ্ছেন চার পাঁচ হাজার ফুচকা, আবার কেউ বানাচ্ছেন দশ বারো হাজার ফুচকা। পাইকারী হিসেবে বিক্রিও করছেন আবার নিজেদের স্টলের জন্যও রয়েছেন বাহারি ফুচকা। নানান জায়গা থেকে মানুষজন আসেন, কেউ ফুচকা কিনতে আবার কেউ ফুচকা খেতে।
কাঁচড়াপাড়ার অন্দরে যে এমন এক সুন্দর জায়গা থাকতে পারে সেও কিন্তু ভাবনার অতীত। সেখানকার মানুষজনের ব্যবহার যেমন ভাল, তেমনই তাঁদের অ্যাপায়ন দেখলে চমকে উঠবেন আপনিও। আর ফুচকার দাম শুনলে অবাক হতেই হবে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল ১০ টাকায় ১২টা ফুচকা আর এখন ১০ টাকায় ১০টা! অন্যান্য জায়গার থেকে সংখ্যায় কিন্তু অনেকটা বেশি। আর বাকি রইল দই ফুচকা কিংবা চাটনি ফুচকা অথবা ফ্লেভারের সেগুলির দাম হয় প্লেট অনুযায়ী। তবে, সব দোকান একসঙ্গে খোলা পেতে হলে বিকেল ৫টার আগে সেখানে গিয়ে লাভ নেই।
এই যে এত নতুন ফুচকার আয়োজন, রেসিপির ভাবনা কীভাবে এসেছিল তাদের? উত্তরে তাঁদের বক্তব্য একটাই, নিজেদের মত করেই সবটা সাজিয়েছি আমরা। রঞ্জিত বালার বক্তব্য, সবাই যখন একরকম ফুচকা বিক্রি করছেন তখন আমার মনে হল একটু অন্যরকম কিছু বানাই। সেই থেকেই চিকেন ফুচকা এবং মাছের ফুচকার শুরু। এদিকে, পাল ফুচকা স্টলে পৌঁছে গেলে আপনি পেয়ে যাবেন নিরামিষ ফুচকা। কিন্তু ফুচকা তাও আবার নিরামিষ? হ্যাঁ! কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করলেন, এখানে কৃষ্ণভক্তরা আসেন। তাঁদের জন্য নিরামিষ ফুচকা রাখা খুব দরকার। তাই, যদি আপনি ফুচকাপ্রেমী হন, তবে অবশ্যই পৌঁছে যেতে হবে এই শহীদ পল্লীতে।