scorecardresearch

তাঁতিপাড়ায় নেই মাকুরের খুটখাট, একে একে হারাচ্ছে বাংলার গামছা শিল্পীরা

বর্তমানে কাঁচামালের বেশি দাম ও বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লাভ হচ্ছে না তাঁত বস্ত্র ও হস্ত শিল্পে

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

গ্রীষ্মের সুনসান দুপুর। খাঁ খাঁ রাস্তাঘাট। কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন মাত্র নেই। দু একটা কোকিলের ডাকের সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসছে মাকুরের খুটখাট শব্দ। খুটখাট শব্দে তাঁত যন্ত্রে চলছে গামছা বোনার কাজ। একষট্টি বছরের বৃদ্ধ পরিমল নাথ সুদক্ষ হাতে এই কাজটি একমনে করে যাচ্ছেন। একটা সময় ছিল যখন এই এলাকায় তাঁতিদের তাঁত যন্ত্রের শব্দে কানে তালা পরে যেত। সময় যত এগিয়েছে এক এক করে হারিয়ে গিয়েছে তাঁত যন্ত্রের সেসব শব্দ। যেমন হারিয়ে গিয়েছে এখানের আম গাছের বাগান। সব গাছ চোখের নিমেষে কেটে তৈরি হয় পাকাবাড়ি। প্রচুর আম গাছ ছিল বলেই এলাকার নাম হয় আমতলা। এখন শুধু নামটায় পড়ে রয়েছে। আর হাতে গোনা কয়েকটা আম গাছ। যেমন আমতলা তাঁতি পাড়ায় তাঁতি বলতে রয়েছে গিয়েছে পরিমল তাঁতি একজনই। আর বাকি সবাই পেশা বদলে অন্য কাজে। আর তাছাড়া হাতে বোনা গামছা এখন ব্যবহার করেই বা কজন? এমনিতেই কদর কমেছে তাঁতে বোনা কাপড়ের। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে প্রাচীন বাংলার এই কুটিরশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে।

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
হাতে বোনা গামছা এখন ব্যবহার করেই বা কজন? এমনিতেই কদর কমেছে তাঁতে বোনা কাপড়ের। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

বসিরহাটের ভ্যাবলার আমতলা এলাকার তাঁতশিল্পীদের তৈরি গামছার এক সময়ে দেশ জোড়া সুনাম ছিল। এই গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়ির বারান্দায় বসানো থাকতো তাঁত এবং চরকা। কেউ কেউ স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করতেন। আর কেউ মহাজনদের কাছ থেকে সুতো বা তুলো নিয়ে চাহিদা মতন তৈরি করে দিতেন গামছা। দিনে দিনে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে লাভ কমেছে। তবে ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না এখানকার শ্রমিকদের। বর্তমানে কাঁচামালের অভাব এবং আর্থিক সংকটের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এই তাঁত শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বর্তমানে কাঁচামালের বেশি দাম ও বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লাভ হচ্ছে না তাঁত বস্ত্র ও হস্ত শিল্পে। কালের নিয়মে তাঁত শিল্পীরাও এই পেশা ছেড়ে বেছে নিয়েছে অন্য পেশাকে। এখন বেশীরভাগ গামছায় তৈরি মেশিনে। মেশিনে তৈরি গামছার বুনন এবং ঘেড় অনেক পাতলা।  

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
মেশিনে তৈরি গামছার বুনন এবং ঘেড় অনেক পাতলা। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

গা মোছা শব্দ থেকে ‘গামছা’ কথাটি এসেছে বলে মনে করা হয়। এটি মূলত এক টুকরো কাপড়। বাংলার সাথে এই কাপড়ের সম্পর্ক বহুযুগ ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অধিকাংশ গামছাতেই দেখা যায় চেকের ব্যবহার। তবে ঠিক কবে থেকে এই গামছার ব্যবহার শুরু হয়েছিলো তা জানা নেই। অনেকে মনে করেন মানুষ যখন থেকে কাপড়ের ব্যবহার শুরু করেছে প্রায় তখন থেকেই গামছার ব্যবহার শুরু। লাল, নীল, সবুজ চেক গামছা প্রথম থেকে বাঙালির সবকিছুতে বিরাজমান। পুজো-বিয়ে-উপনয়ন-শ্রাদ্ধে ঘটের ডগায় সব জায়গাতেই রয়েছে গামছাটি। গামছা ছাড়া কিন্তু বাঙালির পালা-পার্বণ এক্কেবারে অচল। আন্তর্জাতিক মানে ফ্যাশন শোয়ের অংশ হয়েছে বাংলায় তৈরি গামছা। কিন্তু গামছা তৈরির কারিগররা! তাঁরা তো পড়েই রয়েছে অন্ধকারে।

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
আন্তর্জাতিক মানে ফ্যাশন শোয়ের অংশ হয়েছে বাংলায় তৈরি গামছা। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

বাংলার তাঁত শিল্পীরাই চরকা ঘুরিয়ে মাকুরের খুটখাট শব্দে হাত পায়ের জাদুতে তৈরি করে ফেলতেন গামছা। বসিরহাটের নরম কাপড়ের গামছা এভাবেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গোটা দেশে। বসিরহাটের ভ্যাবলা আমতলা এলাকায় আগে এক সময় প্রায় শতাধিক তাঁতশিল্পী হস্তচালিত তাঁত চালাতেন। কিন্তু গোটা এলাকায় তাঁত শিল্পী পরিমল নাথ একা একজনই। গামছা তৈরিতে আগের মত আর উপার্জন হয় না বলেই বেশীরভাগ শিল্পী হস্তচালিত তাঁত বন্ধ করে দিয়েছেন। পরিমল একাই পূর্ব পুরুষের এই কাজকে ধরে রেখেছেন। বলা যেতে পারে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তিনি গামছা তৈরির কাজ করছেন। পরিমল নাথের কথায়, “আমারও এই কাজ করার কোন ইচ্ছে নেই। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। বয়স হয়ে গিয়েছে অন্য কোনও ভারী কাজ করা সম্ভব নয় এই বয়সে। বাবার থেকে শেখা এই কাজটা করেই, কোন মতে দু বেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করছি। আমার সমসাময়িক সকলেই এই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এই কাজ করে এখন কোন লাভ হয় না। বসিরহাট পিস ইন হারমনি সোসাইটির উদ্যোগে প্রদীপ নাথ বাবুর সহযোগিতায় কিছু গামছা এখন বাজারে বিক্রি করে কিছুটা সাহায্যে হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে কোনরকম সহযোগিতায় তো পায়না। আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় আসবে না।”

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
বসিরহাটের গামছার কদর সারা দেশজুড়ে। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

প্রায় চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে গামছা বোনার কাজ করছেন পরিমল নাথ। এক দিনে চারটি গামছা তৈরি করতে পারেন। যন্ত্রচালিত তাঁত চলে আসার পর এখন চোখের নিমেষে তৈরি হয়ে যায় কুড়ি-তিরিশটির মতন গামাছা। যদিও মেশিনে তৈরি গামছার বুনন হাতে বোনা গামছার থেকে অনেক বেশী পাতলা। বসিরহাটের তাঁত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছে বসিরহাট পিস ইন হারমনি সোসাইটি, এই সংস্থার প্রধান প্রদীপ নাথ। প্রদীপ বাবুই বলছিলেন মেশিন পাওয়ার লুম এবং হাতে চালনো মেশিনে তৈরি গামছার পার্থক্যের ব্যাপারে। প্রদীপ নিজেও একজন তাঁতি বংশের ছেলে। তিনি বলছিলেন, “বাংলার তাঁত শিল্পীদের অবস্থা খুবই করুণ। বসিরহাটের গামছার কদর সারা দেশজুড়ে ছিল। কিন্তু এখন শিল্পীরাই নেই। রোজগারের অভাবে তাঁতি ঘরের নতুন প্রজন্মের কেউ আর তাঁত বোনেনা। আমরা তাই গামছা শিল্পীদের কাছ থেকে গামছা কিনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে সেই অর্থ শিল্পীদের হাতেই তুলে দিচ্ছি। যাতে নতুন প্রজন্মের কেউ আগ্রহী হয়।”

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
লকডাউনের জেরে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁতশিল্প। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

ভ্যাবলার আমতলার পাশাপাশি, দেভোগ, দিয়াড়া, সোলাদানা, মাটিয়া, রঘুনাথপুর, বেগমপুর, জয়নগর, পিয়াড়া, কাটিয়াহাট, বড়বাঁকড়া গ্রামেও গামছা তৈরি হয়। বসিরহাটের সীমান্তবর্তী পানিতর গ্রামের শিল্পীদের হাতে তৈরি ‘মুনসি’র গামছা দেশ-বিদেশেও যেত। পানিতরের পশ্চিম কারিগরপাড়ায় মূলত গামছা শিল্পীদেরই বাস। বসিরহাটের গামছা শিল্পীরা গামছা তৈরি করে বাড়ি গাড়ি কিনতে না পারলেও তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না। পর পর অনেকগুলো ধাক্কা সামলাতে না পেরে শিল্পীরা তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। গামছা শিল্পে প্রথম ধাক্কা আসে নোট বন্দির সময়ে। শুরু থেকে পুরো ব্যবসাটাই ছিল নগদ নির্ভর। তার ফলে টানা কয়েক মাস ব্যবসা প্রায় বন্ধ ছিল। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হতে না হতে ফের ধাক্কা আসে জিএসটি চালুর পরে। তাতে সমস্যায় পড়েন গামছার পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা গামছা কেনা কমিয়ে দেন। পুরনো ধাক্কা সামলে যখন ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছিল গামছা শিল্প, তখনই শুরু হয় লকডাউন। লকডাউনের জেরে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁতশিল্প। বেঁচে থাকার তাগিদে শ্রমিকেরা আগ্রহ হারিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্প।

bengali gamcha story, Weaving of Bengal, bengali towel, বাংলার তাঁত, বাংলার গামছা শিল্পও, bengali weaving story, express photo, express photo shashi ghosh
বেঁচে থাকার তাগিদে শ্রমিকেরা আগ্রহ হারিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

পরিমল নাথের মতন যে সব শিল্পীরা যারা অন্য পেশায় যেতে পারেনি তাঁরাই একমাত্র তাঁত যন্ত্রটি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। সকাল সন্ধ্যে মাকুরের খুটখাট শব্দে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন শিল্পীর বুকের জমে থাকা আর্তনাদ।  

 

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Westbengal news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Gamcha story the most usable product of bengal is in lost mode