Advertisment

আমাদের নীতি আছে, নৈতিকতা নেই: গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার

বাংলা পক্ষ বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন কারণে রাজ্য তথা দেশেরও বিভিন্ন জায়গায় আলোচ্য হয়ে উঠেছে। বাংলা পক্ষের মুখ হিসেবে পরিচিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিট্যুটের অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায় একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক হয়ে উঠলেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Garga Chatterjee, Bangla Pokkho

"বিজেপি বাংলায় কোনও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না"

- বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, টেলিভিশন চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে তুমি রেগে গিয়ে তুইতোকারি অবধি করছ। তুমি কি সত্যিই রেগে যাও, না কি পাবলিক স্পেসে, টেলিভিশন শো-য়ে রেগে যাবার ভান করে একটা ছবি তৈরি করো?

Advertisment

যা মনে করো।

আজ বাঙালি হিসেবে আমি একটা টিভিতে গিয়েছি, বাংলার কথা বলতে, বাঙালির কথা বলতে, সেখানে বাংলা ও বাঙালিকে শেষ করে দিচ্ছে যে শক্তি, তার সবচেয়ে তীক্ষ্ণ বর্শাফলা যে দল বিজেপি, তার একটি আগরওয়াল মুখপাত্র যদি আমার কথা আটকায়, তাকে তুই বলব না তো কি পুজো করব!

এটা তো শুধু বিজেপি বলেই নয়, অন্যদের ক্ষেত্রেও তুমি প্রায় একইরকম। হিন্দিভাষী হলে তোমার একটা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া ঘটে। মানে জাতীয় টেলিভিশনের কথা বলছি, সেখানে যখন তুমি যাও, তখন হিন্দি ভাষী প্রতিপক্ষ হলেই তোমার একটা অপটিক্যাল প্রতিক্রিয়া হয়, ছবি হয়ে ওঠে। যে কারণে তুমি কিছুটা ধিকৃত, কিছুটা নিন্দিত, অনেকের কাছে প্রশংসিতও হয়ত। এই যে ছবি, এটা কি তুমি সচেতন ভাবে তৈরি করছ?

একটু খুলে বলি। কোনও জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে কেউ হিন্দি বলে না। যেটা বলে, সেটা হল রাষ্ট্রীয় চ্যানেলে। রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বলতে দূরদর্শন। যেহেতু জাতির ভিত্তি ভাষা, তাই জাতীয় চ্যানেল মানে হচ্ছে, আর প্লাস, এবিপি। ওটা হিন্দি জাতীয় চ্যানেল। হিন্দি ভাষার চ্যানেল। ওগুলোকে দিল্লি চ্যানেল বলা যায়। জাতীয় চ্যানেল মানে আমার কাছে আর প্লাস বা ২৪ ঘণ্টা ইত্যাদি।

বাংলা বানান দেখে রেগে যাবেন না

যখন কোনও ইংরেজি চ্যানেলে একজন, তার মাতৃভাষা যাই হোক, যখন হিন্দি বলা শুরু করে, সে কোনও একটা চুক্তিভঙ্গ করে। এই চুক্তি ভঙ্গের এক্তিয়ারটা সে পায়, কারণ একে চুক্তিভঙ্গ বলে মনেই করা হয় না। মনে করা হয় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেউ যখন হিন্দি বলবে, তখন অন্যরা শুনবে। সাম্রাজ্যবাদ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে হিন্দি একজন বলবে আর অন্যরা চুপ করে শুনবে। যেহেতু আমি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি নামক এক বিকৃত জাতিসত্তার একজন প্রতিনিধি, আমি এটা মেনে নেব না। কারণ আমি সমান নাগরিক তার সঙ্গে। সে যখন হিন্দি বলবে, আমি তখন বাংলা বলব। সে যখন হিন্দি বলবে না ইংরেজি চ্যানেলে, তখন আমি বাংলা বলব না, খুব পরিষ্কার কথা। কিন্তু সে যদি হিন্দি বলে, তবে সে তার উত্তর পাবে। আমি শুধু তাকে বলে দিচ্ছি, আপনি অসভ্যতা করছেন। আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দি জানে না, যে রাষ্ট্রে ৩০ শতাংশ বাঙালি বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানে না, সেখানে আমার সামনে ইংরেজি চ্যানেলে হিন্দি বলা মানে আমার জাতিকে অপমান করা। জাতির অপমান আমি মেনে নেব না।

তুমি সাম্রাজ্যবাদের কথা বলছ। সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপারটা অর্থনীতিগতভাবে দেখলে আমরা জানি পুঁজির অন্তিম স্তর...

এটা মার্ক্সীয় বীক্ষণ।

হ্যাঁ, এটা মার্ক্সীয় বীক্ষণ। কিন্তু তুমি কি সেই বীক্ষণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ বলছ না কি সংস্কৃতিগতভাবে বলছ?

সর্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ। আমি বলি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বলতে আমি কী বুঝি! হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বলতে বুঝি গুজরাটি পুঁজি, মারোয়াড়ি পুঁজি, তার ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গা বাজার হিসেবে দখল করা, আমরা যারা অহিন্দি জাতি, তাদের বাজার হিসেবে দেখা, কাঁচা মাল কেনা, বাজার হিসেবে সেখানে বেচা। এবং এই অহিন্দি জাতির যে মাতৃভূমিগুলি, সেগুলিকে কেন্দ্রীয় ভাবে বাজার দখলের চেষ্টা করা এবং তা বজায় রাখা, তার জন্য জনবিন্যাস বদলের যে প্রক্রিয়া, অর্থাৎ হিন্দি, উর্দু জনবিস্ফোরণকে এসব জায়গায় আউটসোর্স করা, যাতে কিনা একদম মাটি দখল করা যায়- এগুলো হচ্ছে। পুঁজির দখল নেওয়া, জমির দখল নেওয়া, মাটির দখল নেওয়া, এবং পুঁজি যেহেতু আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তথা কল্পনা, এসব কিছুকেই নির্ধারণ করে দেয়, ফলে আমাদের মগজের দখল নেওয়া চলছে। আমরা দাস হয়ে যাব, কিন্তু আমাদের শৃঙ্খলগুলিকে আমরা গয়না ভাবতে শুরু করব। সেই জায়গা থেকে আমরা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বলি। কারণ গুজরাটি-মারোয়াড়ি পুঁজি একটা চুক্তি করে নিয়েছে। যেরকম পাকিস্তানে পাঞ্জাবিরা চুক্তি করে নিয়েছে যে আমরা ভাষাটা নিয়ে তত জোর করব না, উর্দুর মারফতে অন্যান্যগুলো থেকে শোষণ করব। একই রকম ভাবে গুজরাটি বা মারোয়াড়ি পুঁজি চুক্তি করে নিয়েছে যে গুজরাটি ভাষা চাপানো বা মারোয়াড়ি ভাষা চাপানোর প্রকল্পে তাদের তত জোর নেই। কারণ এই বাজার দখলের প্রক্রিয়াটা তারা কোটি কোটি হিন্দি-উর্দু যে গোষ্ঠী, তাদের মাধ্যমে বজায় রাখছে এবং তাদের এগিয়ে দিচ্ছে।

“দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে”: রোদ্দূর রায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার

এই যে উর্দুর উপর তুমি এত জোর দিচ্ছ, এই উর্দুটা কি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যিই কি এত জরুরি? গোটা ভারতের দিকে তাকালে মুসলিম ও উর্দু প্রায় আন্তঃসম্পর্কিত, এবং আজকের ভারতের দিকে তাকালে স্পষ্টতই মুসলিম সম্প্রদায় নিপীড়িত বলে অন্তত চোখে দেখা যাচ্ছে। আজ যখন তুমি উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হচ্ছ, তখন তোমার বর্শামুখ কোনওভাবে মুসলিমদের দিকেও কি সরে যাচ্ছে না?

প্রথম কথা, বাংলা পক্ষ বা আমি, বা আমরা যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাস করি, তাদের সামনে যখনই বলা হয় হিন্দু বা মুসলমান, আমাদের একটা প্রশ্ন থাকে। কাদের হিন্দু, কাদের মুসলমান! উর্দু মুসলমানের ভাষা নয়। কোন মুসলমানের ভাষা! আমাদের মুসলমানের ভাষা তো উর্দু নয়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভাষা দূর দূরান্তেও উর্দু নয়। প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে মুসলমানদের মধ্যে অত্যন্ত সংখ্যালঘু একটি অংশ, বাংলায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা উর্দু ভাষী। একইরকম ভাবে বাংলায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অত্যন্ত ছোট একটা অংশ, তবে ক্রমবর্ধমান অংশ, দুপক্ষেরই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা হচ্ছে হিন্দিভাষী। যাঁরা বলেন, আমার ভাষা হিন্দি, তাঁদের প্রায় একশ শতাংশই ধর্ম হিসেবে হিন্দু লিখবেন। যাঁরা বলেন আমার ভাষা উর্দু, প্রায় একশো শতাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা মুসলমান। তার মানে হচ্ছে, এই দুটো ভাষা ব্যুৎপত্তিগতভাবে এবং বিকাশগতভাবে সাম্প্রদায়িক। পৃথিবীতে খুব কম ভাষা রয়েছে, যার ভাষাটা শুনে ধর্মের কথা বলা যায়। বাংলা ভাষা শুনলে বলা যাবে নাকি, যে এই ভাষার লোকটা হিন্দু না মুসলিম না খ্রিস্টান! হিন্দি যেভাবে হিন্দুদের ভাষা, উর্দুও সেভাবে মুসলিমদের ভাষা। মসজিদে নাগরী হরফে লেখা থাকে না, মন্দিরেও উর্দু হরফে লেখা থাকে না। কেন! অথচ এমন একটা ব্যাপার যে হিন্দিতে কথা বললে, ভারতের জনসংখ্যার যত শতাংশ বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যার তার চেয়ে বেশি শতাংশ বুঝতে পারেন। অর্থাৎ এ দুটো একই ভাষা।

কিন্তু বহু হিন্দিভাষী মুসলিম রয়েছেন।

থাকতে পারে, আমি দেখি না।

বিহারের যে মুসলিমরা...

তারা নিজেদের উর্দুভাষী বলে।

তারা পরিষ্কার হিন্দি ভাষায় কথা বলে।

হিন্দি আর উর্দু একই ভাষা, এটাই হচ্ছে কথা। হিন্দি আর উর্দু কি আলাদা ভাষা! নরেন্দ্র মোদী যখন লাল কেল্লা থেকে ভাষণ দেন, উনি যে ভাষায় ভাষণ দেন, সেটাকে উনি বলেন হিন্দি, পাকিস্তানের জনসংখ্যার বেশি শতাংশ লোক বুঝতে পারে সেই ভাষাটা, ভারতের জনগণের চেয়ে। তার মানে কী, তার মানে দুটো একই ভাষা। একই ভাষাকে তাদের এলাকার যে রাজনীতি, সেটা দিয়ে নোংরাভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। আমি একটু ফার্সিটার্সি মিশিয়ে দিয়ে এটাকে উর্দু বলব, আর এরকম একটা হরফ লিখব, আর একটু তৎসম টৎসম দিয়ে নাগরী দেব, হয়ে গেল হিন্দি। এরকম ভাবে তো ভাষার বিকাশ হয় না। দুটো একই ভাষা। এবার প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা এখানে, ৯৫ শতাংশ মুসলমানের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধ নেই। ওরা আমাদের লোক। বাঙালি মুসলমান। ৫ শতাংশ বাকিদের সঙ্গেও আমাদের কোনও বিরোধ নেই, যদি একজন বাঙালি মুসলমান উত্তরপ্রদেশে গিয়ে উর্দু মুসলমানের কাছে সম্মান পায়, তাহলে আমরাও একই সম্মান দিতে রাজি। কোনও সমস্যা নেই। যদি সেখানে গিয়ে একজন বাঙালি মুসলমান তার সংস্থার ফেস্টুন ইত্যাদি বাংলা ভাষায় বানাতে পারে, তারা ঠিক ততটাই এখানে এসে তাদের ভাষায় নিজেদের ফেস্টুন বানাক। একজন বাঙালি মুসলমান বা বাঙালি হিন্দু বিহারে বা উত্তরপ্রদেশে গিয়ে যত বাংলা অ্যাকাডেমি বানাতে পারে, হিন্দি বা উর্দুভাষীরা এসে এখানে তত হিন্দি বা উর্দু অ্যাকাডেমি বানাক। কোনও সমস্যা নেই। আমরা সাম্যে বিশ্বাসী।

অনিল আচার্যর সাক্ষাৎকার

তুমি যে ভাষার কথা বললে, এটা একটু অ্যাকাডেমিক কৌতূহলও বটে, যে গান্ধী যে ভাষায় কথা বলতেন, সেটা হিন্দুস্থানি ভাষা। পরিষদে যখন ভাষা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখন হিন্দুস্থানি ভাষার পক্ষে অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যেটা ঠিক হিন্দি বা উর্দু নয়, দুটোর মিশ্রণ। সেরকম কোনও ভাষা কি তোমার মেনে নিতে আপত্তি ছিল! রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ভাষা থাকলে কি প্রশাসনিক স্তরে কাজকর্মের সুবিধে হত বলে তুমি মনে করো!

আবার বলি। রাষ্ট্রীয় স্তর আর জাতীয় স্তর যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি। পশ্চিমবাংলায় যা হচ্ছে, সেটা আমাদের জাতীয় স্তর। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যেটা হচ্ছে, যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্ত রয়েছে, সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্তর। আমাদের জাতীয় ভাষা বাংলা। ভারত ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। আমাদের সংবিধানের প্রথম লাইন India, That is Bharat is a union of States. এই কথাটা আমি কেন ইংরেজিতে বললাম! তার কারণ আজ অবধি কোনও অনুমোদিত বাংলা সংস্করণ ভারতীয় সংবিধানের নেই। অর্থাৎ আমরা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের কী মৌলিক প্রেক্ষিত ও পরিমণ্ডলে বাস করি তার এটা উদাহরণ। হয়ত শস্তা উদাহরণ, কিন্তু শস্তা উদাহরণ দিয়ে অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়। আমি এই যে এত নিয়মের কথা বলছি, তার কারণ আমি হচ্ছি আমি একজন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি, ফলে আমি এই রাষ্ট্রীয় স্তরের সঙ্গে একটা আলাপে যেতে পারছি, যেটা আমার জাতির ৮৩ শতাংশ মানুষ পারে না।

আন্নাদুরাই, তামিল জাতীয়তাবাদের নেতা এবং প্রতিটি অহিন্দি জাতির মুক্তিসূর্য, একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, বহুজাতিক রাষ্ট্রে যদি সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, সেখানে যদি একটা কমোনালিটির কথা বলি, তাহলে তার এমন একটা ভাষা হতে হবে, যার সুবিধা এবং অসুবিধা প্রতিটি মানুষ একইভাবে পাবে। অর্থাৎ সমদূরত্বের ভাষা হতে হবে। তোমার মাতৃভাষায় তুমি পরীক্ষা দিচ্ছ, আর তোমার মাতৃভাষা আমি শিখে পরীক্ষা দিচ্ছি, এটা তো সমান হল না। তোমার উত্তর প্রদেশ বা এরকম কোনও জায়গায় তুমি হিন্দিতে সাইনবোর্ড দাও, আমার জায়গাতেও তুমি হিন্দিতে সাইনবোর্ড দাও, আমার এখানে বলে কয়ে তুমি মাঝে মাঝে বাংলায় সাইনবোর্ড দাও, তোমার ওখানে বাংলায় সাইনবোর্ড দাও না। পরিষ্কার কথা ভারত যেহেতু বহুজাতিক রাষ্ট্র, সেখানে বহুজাতিকতা যতটা বাস্তব, বহুভাষিকতাও ততটাই বাস্তব। বহুজাতীয়তা রক্ষা করতে গেলে, বহুভাষিকতা রক্ষা করতে হবে। তার ভিত্তি হতে হবে সমানাধিকার, অন্য কোনও ভিত্তি নয়। রাষ্ট্রিক কোনও স্তরে, একজন হিন্দি ভাষী একজন বাংলাভাষীর চেয়ে যতটুকু বেশি সুবিধা পাবে, সেই তফাৎটুকু ছেঁটে দেবার জন্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ।

বিশ্লেষণ: বাংলা পক্ষ কি সত্যিই তৃণমূলের বি টিম?

এই যে তুমি বললে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত বলে বিভিন্ন সুযোগ পাও। আমার এখানে একটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, আরও অনেকেরই রয়েছে, বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এই যে তুমি একজন অ্যাকাডেমিক্সের লোক, অ্যাকাডেমিক্সে বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে লিখিত নথি বা বইয়ের বিবলিওগ্রাফি খুলে দেখলেই দেখা যাবে, যদি গর্গ চ্যাটার্জির নাম রাখতে হয়, তাহলে লেখা হবে চ্যাটার্জি জি বা চ্যাটার্জি গর্গ। এই লেখার ধরন সম্পূর্ণ ভিনদেশি, বাংলা নয়। এখনও পর্যন্ত অ্যাকাডেমিক্সে কোনও বিষয়ের বাংলা পরিভাষা তৈরি হয়নি। ইংরেজির এই যে আধিপত্য, তোমার কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, যা হিন্দি আধিপত্যের থেকে অনেক বেশি রয়েছে!

আমরা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে বাস করি। ইংরেজ এখানে বাস করে না। ফলে ইংরেজি আধিপত্য, যা বাস্তব, তার মাধ্যমে আমার স্বজাতীয় কিছু লোক আমার ওপর টেক্কা দিতে পারে। ইংরেজ এসে টেক্কা দিয়ে যাবে না। মূলত, পুঁজি, চাকরি, বাজার, এমনকি বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্রেও, অন্তত বাংলার ভেতরে। যে কারণে এই মুহূর্তে আমরা সেটিকে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব বলে মনে করি না। হিন্দি উর্দু কিন্তু রয়েছে, তারা বাঙালির থেকে গ্রোথ রেটে আড়াই গুণ করে বাড়ছে। তারা আমাদের জায়গা দখল করছে, মাটি দখল করছে, পাড়া দখল করছে। বাঙালিই যদি না থাকে, তাহলে বাংলার বৌদ্ধিক চর্চার পরিসর কোথা থেকে থাকবে! আমরা কি আর্কাইভ হয়ে যাব! আমাদের কিন্তু বুঝতে হবে ঘরে যখন আগুন লেগেছে, তখন ঘরের দেওয়ালের রং কী হবে, তা নির্ধারণ করবার সময় নয়। আমরা এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছি, বাঙালি এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছে। বাঙালি যদি এই বাংলায় জনবিন্যাসের ক্ষেত্রে, বাজার চাকরি জমি এই জায়গাগুলো থেকে বেদখল হয়ে যায়, তাহলে ইংরেজি যে আধিপত্য, তার বিরুদ্ধে যে লড়াই, সে লড়াই দেবার মত জায়গাও থাকবে না, কেবলমাত্র একটা অবস্থানে পরিণত হবে। আজ এটা বাস্তব যে ইংরেজির মাধ্যমে বিশ্বজ্ঞান চলাচল করে। কেন হয়, তার কারণ হিসেবে আমি যেটা দেখি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কারা জিতল, কারা হারল, তার মাধ্যমেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে কোন কোন জায়গা থেকে আধিপত্য হবে, অর্থাৎ ইংল্যান্ড-আমেরিকা, সেটা ঠিক হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলছি, যেহেতু ১৯৪৫-এর আগে অনেকগুলি ঔপনিবেশিক শক্তি এই জায়গাটার সঙ্গে লড়াই করছিল, ফলে আমার যে বিষয়, মনোবিজ্ঞান, ৭০-এর দশক পর্যন্তও আমি যেখানে পিএইচডি করেছি, সেই হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান শিখতে হত। তার কারণ প্রচুর মেটিরিয়াল জার্মানে ছিল। কিন্তু তারপরে আর শিখতে হত না, আমাকে শিখতে হয়নি। আবার একইসঙ্গে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাপানে, চিনে অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদ যেখানে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এবং পুঁজি-চাকরি-বাজার যেখানে সেই ভাষিক জাতির কাছে একদম কুক্ষিগত, সেখানে কিন্তু তারা ধীরে ধীরে প্রতিনির্মাণ করে ফেলছে। প্রথমেই তারা সব বইগুলো তর্জমা করে ফেলছে। যার ফলে তারা যে এই লব্ধ বিশ্বজ্ঞান, তারা ব্যাপ্ত করে ফেলছে। আজ, এই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি এর ধারে কাছে নেই। সেখানে তার নিজের মাটিতে প্রতিটি স্কুলে বাংলা শেখানো হয় না। তার যে এলিট শ্রেণি, তারা হিন্দি-ইংরেজিমুখো, মূলত হিন্দিমুখো। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয় এই ইংরেজিবিরোধী লড়াইটি শুধু আকাশকুসুম নয়, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের কিছু শ্রেণির একটু অন্তত বুঝে নেবার জায়গাটাকেও অবলুপ্ত করে দেয়। কারণ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হিন্দি আর ইংরেজি দেয়। হিন্দি দখল করে, আর ইংরেজি জানে আমরা সামান্য যা কিছু  পাই, এরপর আমরা তাও পাব না।

আমাদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার, প্রতিটি ভাষাকে সমানাধিকার দিতে হবে। প্রতিটি ভাষা মানে বাংলাকে দিতে হবে, প্রতিটি ভাষার কথা আমি বলছি, তার কারণ তামিলরা এটা চায় আমরা তা জানি, তামিল, মারাঠি, কন্নড়, পাঞ্জাবি, আমরা নানারকম ভাষাজাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের জায়গা থেকে যুক্ত, তাই জানি। কিন্তু আমরা শুধু বাংলার কথা বলি। অন্যরা নিজেদেরটা বুঝে নেবে। সকলেই নিজেদেরটা বুঝে নেয় শেষ পর্যন্ত। এই তো কদিন আগে ইসরোর গুজরাটে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে, গুজরাটের স্কুল থেকে পাশ করতে হবে, তবে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে নেওয়া হবে। আমি তো মনে করি এটা খুব ভাল ব্যাপার- যে ইসরোর যে গুজরাটের সেন্টার, সেখানে অবশ্যই গুজরাটের স্কুলে পড়া ছাত্রছাত্রীদের চাকরি দেওয়া উচিত। আমি তো বাংলায় প্রতিটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে এই নিয়মটাই চাই।

ইংরেজির বিরুদ্ধে লড়াইটা মুলতুবি নয়। তাকে আমাদের সম্পূর্ণভাবে পৃথিবীতে সূর্যের তলায়, ঈশ্বরের বানানো এই পৃথিবীতে সকলের সঙ্গে সমানউচ্চতায়, সমান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়ানোর জন্য, সেই লড়াইটা একদিন লড়তে হবে। কিন্তু সে লড়াইটা হচ্ছে শতশত বছরের ঔপনিবেশিক পুঁজির কায়েম করা পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই। আর আমার সামনে আমার জমি মাটি দখলের যে লড়াই, আমরা অবশ্যই তাকে অগ্রাধিকার দেব, কারণ, আমরা লড়ার জন্য লড়ব না, আমরা জেতার জন্য লড়ব। ফলে আমরা প্রথমে সেই লড়াইগুলিই লড়ব, যেগুলি না লড়লে আমার অস্তিত্বের সংকট, এবং যেগুলো আমরা জিততে পারি। অস্তিত্বের সংকট যখন বাঁচানো যাবে, তখন আমরা অন্য লড়াইগুলো অবশ্যই লড়ব। যা যা করে বাঙালির পকেটে টাকা ঢুকবে, যা যা করে বাঙালির ঠাট বাট বাড়বে, যা যা করলে বাঙালির কান্না মুছবে, আমরা তার সব করব!

বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য

মানে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার?

এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন দ্য ইন্টারেস্ট অফ দ্য বেঙ্গলি পিপল।

তাহলে এটা যুদ্ধ তো?

যুদ্ধ তো, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ লড়াই কীভাবে হবে? সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের তো একটাই নাম, জাতীয় প্রতিরোধ। জাতীয় প্রতিরোধ লড়াইয়ের মতই হবে।

এই যে তুমি প্রতিরোধের কথা বললে, এর জন্য তো একটা সংগঠন দরকার। তোমাদের সংগঠন একাধিকবার ভেঙেছে, আর আগেও একাধিক সংগঠন ছিল, যারা বাংলা ভাষার সংগঠন। তা সত্ত্বেও নতুন সংগঠন বানালে কেন, আর তা এতবার ভাঙলই বা কেন?

প্রথম যেটা বলার, বাংলা পক্ষ সংগঠন হল একটি রোজ রোজ আরও ব্যাপ্ত একটা খরস্রোতা নদীর মতো। আমাদের গন্তব্য বাঙালির গন্তব্য। এ নদীপথে কোন বাধা এলে, তার বাইরের হোক বা ভিতরের হোক, তা জাতির স্বার্থে পাশে সরিয়ে এগোতে হবে। আমাদের আসলে এসবের সময় নেই। কেউ কেউ হয়তো বাংলা পক্ষর এই দুর্বার গতির সাথে তাল মেলাতে পারেনি বা সারা বাংলাকে কলকাতায় বসে জ্ঞান দেবার মঞ্চ হিসেবে ঠাহর করে পরে বুঝেছেন যে এ সংগঠন অন্য। আমরা একটি পেশাদার সংগঠন যা লড়ার জন্য লড়ে না, জেতার জন্য লড়ে এবং জেতার জন্য সব করতে পারে, তাতে কার কী এসে গেল, তার ধার ধারে না। যা করা দরকার, বাঙালির সমস্যা সমাধান করতে কার পায়ে পড়া দরকার, যে সময়ে যে মুখ বেচা দরকার, বাঙালিকে বাঁচাতে কাকে চমকানো দরকার, যে সময়ে যাকে স্টেজে তোলা দরকার, জেলার ছেলেদের সাথে বেইমানি না করে বাঙালি জাতির দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ সংগ্রাম টিকিয়ে রাখতে যে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, বাংলা পক্ষ তা সব করে জেলায় জেলায় সংগঠনের বাস্তবতার ভিত্তিতে, বাঙালি জাতির এই আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা ও সামনের শত্রুর শক্তি বিচারের মাধ্যমে।

এর মধ্যে কোনও লুকোছাপা নেই। আমরা নীতিতে অবিচল, নৈতিকতার ধার আমরা ধারি না। আমরা ফেয়ারপ্লে ট্রফি না, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিততে লড়ছি। এর আগে এসব মনে হয় কোন সংগঠনের থেকে এসব শোনেননি। তাই আমরা বাংলা পক্ষ। বাংলা পক্ষর মাধ্যমে বাঙালী এবার শোনাবে, শত্রুরা শুনবে। শুনে বুঝলে ভালো। না হলে এঁড়েদের বোঝানোর অনেক কায়দা আমাদের জানা, সেগুলো প্রয়োগের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাস আমাদের আছে।

এই আমরা মানে কে? গর্গ চট্টোপাধ্যায় প্লাস?

আমরা মানে বাংলা পক্ষ সংগঠনের যে সামগ্রিক যৌথতা।

সেটা প্রকাশ্য নয়!

কেন!

আমরা তো দেখে এসেছি গণ সংগঠন, প্রকাশ্য সংগঠন। বাংলা পক্ষ তাহলে গণ সংগঠন নয়।

অবশ্যই গণ সংগঠন। গণ সংগঠনের মিটিং কি প্রকাশ্য হয় নাকি!

তা হয় না, কিন্তু কর্মসূচি থাকে
কর্মসূচি কীভাবে হচ্ছে, তার মিনিটস প্রকাশ্যে আনা হবে নাকি!

গঠনতন্ত্র থাকবে তো?

সে তো আমাদের ব্যাপার।

সে তো সবটাই তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু গণসংগঠন বলতে আমরা যে চেহারা দেখতে অভ্যস্ত, তার কর্মসূচি এবং গঠনতন্ত্র প্রকাশ্যে থাকে। বাংলা পক্ষ সেখান থেকে একটা ডিপার্চার ঘটিয়েছে তাহলে! তাদের গঠনতন্ত্র প্রকাশ্য নয়। তার সাংগঠনিক চেহারা প্রকাশ্য নয়।

যেটুকু প্রকাশ করা হয়েছে, তা-ই প্রকাশ্য।

তোমরা একটা নতুন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে কেন!

আমরা মনে করি আমরা বাঙালি জাতির সব অধিকার পাওয়ার, আমরা মনে করি আমরা বাংলার সব অধিকার ফিরিয়ে নেওয়ার, আমরা মনে করি আমরা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এই বাংলার সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন রূপায়ণের একমাত্র প্রতিনিধি। যার ফলে আমরা ভিএইচপি দ্বারা আক্রান্ত হই, যার ফলে আমাদের জামাতি বলা হয়, যার ফলে আমাদের তৃণমূলের বি টিম বলা হয়, যার ফলে আমাদের সম্পর্কে মুকুল রায়ের সঙ্গে মিটিং করে টাকা নিয়েছি বলা হয়, যার ফলে এনআইএ আমাদের পিছনে লাগে। আর কারও ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বোঝে, এই মুহূর্তে বাংলায় এমন একটি সংগঠনের উদ্ভব ঘটেছে, যার তির ছোট হতে পারে, দুর্বল দেখতে হতে পারে, কিন্তু সে তিরের অভিমুখ একদম হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের হৃৎপিণ্ডের দিকে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে এমন শক্তিকে সাম্রাজ্যবাদীরাই যদি পাত্তা না দেয়, তাহলে...

তুমি বলছ বাংলা পক্ষ একমাত্র সংগঠন। বাংলা পক্ষ থেকে যারা বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে।

কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ফেসবুক পোস্টে একজন তালিকা দিয়ে জানিয়েছেন কারা কারা বেরিয়েছেন। সেখানে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগও করা হয়েছে। এটা একটা বিষয়। আর এই যে তৃণমূলের বি টিম প্রসঙ্গ, কিছুদিন আগেও তুমি টেলিভিশন চ্যানেলে তৃণমূল সমর্থক পরিচয়ে যেতে। এর আগেই কিন্তু বাংলা পক্ষ তাদের ৩০ দফা প্রকাশ করেছে। সে সময়ে প্রশ্ন উঠেছে, তোমার এই পরিচয় নিয়ে।

পুজোর যে যে লগ্নে দেবতাকে যা যা নৈবেদ্য দিতে হবে, আমরা তাই দেব।

বাংলা পক্ষ সংগঠন নিজের কাছে পরিষ্কার যে তারা কী করছে, বাঙালি জাতির কাছে পরিষ্কার যে তারা কী করছে। বাংলা পক্ষ একটি দু বছরের সংগঠন। সেখান থেকে কে বেরোল, কে বহিষ্কৃত হল, তাই নিয়ে এত মানুষের মাথাব্যথাই আমাদের সাফল্য। অল পাবলিসিটি ইজ গুড পাবলিসিটি। আমরা চাই আমাদের নিয়ে আরও আলোচনা হোক, আরও সমালোচনা হোক, আরও গালিগালাজ দেওয়া হোক। বাঙালি জাতির জেলায় জেলায় পালসটা কী, সে কথা বাংলা পক্ষ জানে। সেই নিয়ে আমাদের কোনও আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। আমরা জানি আমরা যা করছি তাতে মোটামুটি ভাবে বাঙালি জাতি দুহাত তুলে সমর্থন করছে। আমাদের ভুল থাকতেই পারে, আমরা মানুষ।

ভাষা দিবসে ফিরে দেখা; কেমন আছে বাংলা অভিধান?

বাংলা পক্ষ কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বাংলা পক্ষ এই সমাজের এই সময়ের মানুষদের দিয়ে তৈরি। এই সময়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি যারা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়ার জন্য এটা তো পূর্বশর্ত যে তাকে অসাম্প্রদায়িক হতে হবে, সেই প্রেক্ষিতে কেউ তৃণমূল সমর্থক হতে পারে, যেমন আমি, কেউ সিপিএম সমর্থক হতে পারে, যেমনটা বাংলা পক্ষের অনেকেই, কেউ কংগ্রেস বা এসইউসি সমর্থক হতে পারেন। এই সত্তাগুলির সঙ্গে তার বাঙালি জাতীয়তাবাদী হওয়া বা বাংলা পক্ষ হওয়া একটুও সাংঘর্ষিক নয়। দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় হল জামার মত, আর জাতির পরিচয় হল চামড়ার মত। জামা বদলানো যায়, চামড়া বদলানো যায় না। চামড়ার প্রতি আনুগত্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলা পক্ষ থেকে যে যে বেরিয়ে গেল, তারা কি সবাই কজ থেকে বেরিয়ে গেল?

বাংলা পক্ষ একটি আন্দোলনের নাম। যে যে এই আন্দোলনের একটা সময়ে একটা পোস্টারও লিখেছে, সে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।

তারা যখন তোমাকে প্রশ্ন করছে, তখন তার উত্তর দেবার দায় এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?

সংগঠনের বাইরে কাউকে উত্তর দেবার দায় আমার নেই, বাঙালি জাতিকে ছাড়া।

এই প্রশ্নকারীরাও তো বাঙালি জাতির অংশ।

বাংলা পক্ষ বাঙালি জাতির অধিকারবোধ এবং বাঙালিদের অধিকার কায়েমে একমাত্র অস্ত্র। সেই অস্ত্রে যদি আঘাত করা হয়, তাহলে বাঙালি জাতির অধিকার হরণ করা হয়। সংগঠনের মধ্যে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়, সংগঠনের বাইরে কোনও উত্তর দেবার দায় আমাদের নেই।

বাঙালি জাতির একমাত্র সংগঠন হিসেবে বারবার এই যে দাবি, সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় না?

বাড়াবাড়ি তো বটেই! প্রচণ্ড রকমের বাড়াবাড়ি হবে। তার কিছুই এখনও দেখা যায়নি।

তোমরা কি হিংসায় বিশ্বাস করো!

আমরা সংবিধান স্বীকৃত আত্মরক্ষায় বিশ্বাস করি।

তোমাদের বর্শামুখ মোটামুটি যা দেখা যাচ্ছে বাংলায়, তোমরা ভালনারেবল অংশকে টার্গেট করছ। হকার, ছোট ব্যবসায়ী...

(কথা শেষ না করতে দিয়ে) বিড়লা

প্যান্টালুনস একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

রাধা স্টিল মালিক

তোমরা কলকাতার অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল টার্গেট করছ না। যে সব জায়গায় বাঙালিরা প্রকৃত সংখ্যালঘু, সেখানে তোমাদের প্রায় কোনও ফুটস্টেপ নেই।

আমার খুব ভাল লাগল যে সমস্যাটা সকলেরই জানা। এটা বাংলা পক্ষের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সাফল্য যে সমস্যাগুলো বাংলা পক্ষের কাছে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে এই সমস্যাটার সমাধান কেন হচ্ছে না। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এটা বাংলা পক্ষ করছে না কেন, এই প্রশ্ন রাখা। এই যে সংগঠনের কাছে জাতির দাবি, এটাই আমাদের পাথেয়।

বাংলার মাটিতে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের যে ক্ষমতা, যে শক্তি তার দুটো ভিত্তি। পুঁজি ও সংখ্যা। পুঁজি মারোয়াড়ির, সংখ্যা হিন্দিভাষীর। মানি প্লাস নাম্বার ইকোয়ালস টু পাওয়ার। অর্থের জায়গায় বাঙালির পুনর্দখল চাই, সংখ্যাতেও বাঙালির পুনর্দখল চাই। পুনর্দখলের লড়াইতে যে লড়াই সহজতর, আমরা সেই লড়াইটা লড়ব। সহজতর লড়াই সফল হলে কঠিন লড়াই লড়ব। তারপর আরও কঠিনতর লড়াই লড়ব। একটা জিনিস আমরা করব না, কোনও রকম নিউট্রাল বা বিপরীত দলের সমর্থকের গ্যালারি থেকে ভেসে আসা ইনস্ট্রাকশনে আমাদের টিম বল খেলবে না। আর আমরা ফেয়ার প্লে ট্রফির জন্য লড়ছি না।

রফিক-সালাম-বরকতকে মনে আছে, আর ধীরেন্দ্রনাথ?

আচ্ছা, এই যে তোমরা যখন প্রায়ই ফেসবুক লাইভে যাও, তখন দেখি, তোমরা সম্বোধন করার সময়ে আপনি বলো না, তুমি বলো। আমরা তো ছোটবেলায় গৌরবে বহুবচন, বহুবচনে গৌরব, এসব শিখেছি। এটার কি কোনও নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে!

জাতির প্রতিটি লোক আমাদের আপন। কেউ কাকা, কেউ জ্যাঠা, কেউ বাবা। আর এই যে প্রশ্নটা করলে, এই প্রশ্নের জায়গাটা যাতে থাকে, এই ঘের দেওয়ার জন্য বাংলা পক্ষ।

প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেবার সিদ্ধান্ত কি ঠিক ছিল?

একদম না। এ নিয়ে কোনও সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি ভুল ছিল।

তোমরা তো বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক দল বলেও মনে করো না?

আমরা বিজেপিকে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দল বলে মনে করি না, বাংলায় আমরা তাকে মনে করি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী সংগঠন। বিজেপি হিন্দুস্তানি এলাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দল, কারণ সে হিন্দুস্তানি হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলার মাটিতে সে যেহেতু হিন্দু বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে না, ফলে সততই সে সাম্রাজ্যবাদী, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। কারণ বাংলায় কোনও সম্প্রদায়ের সে প্রতিনিধি নয়। বাংলার কোনও সম্প্রদায়ের ভাল সে চায় না।

তোমাদের আয়ের উৎস কী?

বাঙালির মাধ্যমে, বন্ধুদের মাধ্যমে, নিজেদের মাধ্যমে। এখন ধারে চলছে।

তোমাদের যে চাহিদা বা যে স্বপ্ন, এসব পূরণ করবার জন্য বাঙালি পুঁজি প্রয়োজন। তোমাদের কাছে কি এরকম পরিস্থিতির উদয় হয়েছে বলে মনে হয়?

একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। বাংলা পক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করছে। আমাদের কাজ বিভিন্ন রকম কাজের প্রেক্ষিত, বাজার যাতে তৈরি হওয়া সেই পরিস্থিতি তৈরি। আমরা স্বদেশি করব। পুঁজি-বাজার-চাকরি-জমি-টেন্ডার সর্বক্ষেত্রে স্বজনপোষণ যাতে হয়, সে কারণে সব রাজনৈতিক দলের উপর চাপ তৈরি করব। তা যারা করবে না, তাদের সম্পর্কে মানুষের কাছে বলব, যে তোমার জল, তোমার মাটি, তোমার ফুটপাথ, তোমার হাইওয়ে তোমার দখলে রাখতে দিচ্ছে না এরা। তাদের বলব পুনর্দখল করতে। পুনর্দখল হলেই বাকিটা এমনিই হবে। দ্বারকানাথ ভাল টাকা করেছিল, গীতবিতান হয়েছে।

তোমার বিরুদ্ধে জেন্ডার ইনসেনসিটিভিটির একাধিক অভিযোগ উঠেছে, তোমার বিভিন্ন সময়ের বয়ান নিয়ে। তুমি সিবিএসই স্কুলে যেসব মেয়েরা পড়তে যায়, তাদের সম্পর্কে অতীব খারাপ ভাষায় হিন্দিভাষী পুরুষের অঙ্কশায়িনী হবার প্রণোদনার কথা প্রকাশ্যে সোশাল মিডিয়ায় লিখেছিলে।

সাম্রাজ্যবাদ একটি সর্বগ্রাসী জিনিস। নিজস্বতা, নিজের কল্পনা, নিজের ইচ্ছা, স্বেচ্ছা - সাম্রাজ্যবাদ এই সবকটা জিনিসকে বিকৃত করে এবং ধ্বংস করে। অর্থাৎ, কিসের দ্বারা আমরা আকর্ষিত হই, তাকে বিকৃত করে। আমাদের নান্দনিকতার ধারণাকে বিকৃত করে। আমরা কোথায় কাজ করতে যাব, কোনটাকে উঁচু মনে করি, কোনটাকে নিচু মনে করি, সাম্রাজ্যবাদ নিজের স্বার্থে এ সবকে বিকৃত করে। বাঙালিরা দাস জাতি, বাঙালিনীরা দাস জাতির নারী।

এখানে যে প্রসঙ্গে বললে, যে স্কুলে বাংলা ভাষা প্রথম ভাষা নেওয়া যায় না, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা নেইই। অর্থাৎ ১২ বছর ধরে বাংলাহীন একটা প্রেক্ষিতে বাঙালি মেয়েদের একরকম ভাবে রচনা করা হয়। কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না যে এক ধরনের মনন রচনার জন্যই বোর্ডগুলো তৈরি হয়। এমনভাবে সেগুলো তৈরি হয়, যাতে কিনা পুঁজির যে কেন্দ্রিকরণ ঘটছে, গ্রেটার দিল্লি এলাকায়, সাম্রাজ্যবাদের একেবারে কেন্দ্রস্থলে, তার জন্য সাপ্লাই সিস্টেম তৈরি হচ্ছে। কোথায়, না যেখানে কন্যা ভ্রূণ হত্যা করা হয়, চরম নারীবিরোধী, ধর্ষণে শীর্ষ এলাকা। সেখানকার পুং সমাজের মধ্যে একটা জিঘাংসা রয়েছে, নারীর প্রতি এবং বিশেষভাবে বাঙালি নারীর প্রতি। ভোজপুরি হিন্দি গানের পরের পর অ্যালবামে, যেখানে বাঙালি নারীকে টার্গেট করা হয়েছে। কয়েকটা অ্যালবামের নাম আমি শুনিয়ে দিতে চাই। বঙ্গালওয়ালি হামকে আঁখ মারেলি, বঙ্গালওয়ালি ভৌজি দেওঘর চলি, বঙ্গালওয়ালি মাল, এ বঙ্গালওয়ালি মাল চিজ লুঠ যাই হো, বঙ্গাল কে হৈ মাল, বঙ্গালওয়ালি মাল সিল টুট যাই হো, কলকাতা কা মালওয়া, বঙ্গালওয়ালি উঠাও ঘাগরি, ইত্যাদি। আমরা এই প্রেক্ষিতে বাস করছি। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বাংলায় জনবিস্ফোরণের পর্যায়ে এবং গোটা হিন্দি বলায় জুড়ে এই মানসিকতা সম্পন্ন এলাকায় বাস করছি। যেখানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ তার বোর্ডের মাধ্যমে, সারক্ষণ ঈপ্সিত পুরুষ হিসেবে এই পুরুষগুলোকে তুলে ধরছে। কর্মক্ষেত্রের জায়গাগুলো এমনভাবে তৈরি করছে, যেখানে ঘিরে আছে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ করে যারা, সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণ করে যারা, এবং রসগুল্লা বলে ভিডিও বানাচ্ছে কেবলমাত্র বাঙালি নারীদের নিয়ে। বাঙালি নারীজাতিকে তারা সুলভ ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করে এবং বাঙালি পুরুষকে যৌনক্ষমতাহীনে পরিণত করার চেষ্টা করে। এবং এই নির্মাণের মাধ্যমে তারা দেখাতে চায় বাঙালি পুরুষ যেহেতু যৌনক্ষমতাহীন, সেকারণে ধর্ষিতা হলেও বাঙালি নারী বাঙালি পুরুষের চেয়ে এই হিন্দুস্তানি পুরুষকে চায়। এই নির্মাণের মধ্যে আমরা বাস করছি। জেন্ডার সেনসিটিভির কথা কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিত ছাড়া হয় না। আমরা এই প্রেক্ষিতকে ধ্বংস করতে চাই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাঠ ও প্রেক্ষিত ছাড়া এই বিষয়টা বোঝা যাবে না। সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিত ছাড়া ভাষাতাত্ত্বিক সমালোচনা পরে হবে। এই ভাষাতাত্ত্বিক সমালোচনা যেন আমাদের যারা সমালোচক, তাঁদের সমালোচনার প্রেক্ষিত যাতে তাঁরা আরও বড় করতে পারেন, বজায় রাখতে পারেন, যা বজায় রাখার পূর্বশর্ত হল একটি সভ্য সমাজ, সেই সভ্য সমাজ বাংলা পক্ষ রক্ষা করতে চায়। সভ্যের কাজ অসভ্যকে সভ্য করা নয়। সভ্যের কাজ হল সভ্যকে অসভ্যের কাছ থেকে রক্ষা করা।

তোমাদের সম্পর্কে একটা সমালোচনা হল, তোমাদের কোনও কোনও পদক্ষেপের ধরন সমমনস্কদের বা সম্ভাব্য দূরবর্তী সমালোচকদের, তোমাদের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

বাংলা পক্ষের যে সংগঠন, বয়ান, কৌশল, সংগ্রাম, আন্দোলন ও আদর্শ, যে আদর্শ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি শরৎ বসুর থেকে, ফজলুল হকের থেকে, অশোক মিত্র, সুভাষচন্দ্র, বঙ্কিম, নজরুলের থেকে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই সত্য পুনরুত্থিত হচ্ছে। সত্যের প্রকাশ অনভ্যাসের ফলে অনেকের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে। ফলে কাউকে কাউকে কিছু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ রাখতে হতে পারে, মুখ ফিরিয়ে নিতে হতে পারে। কিন্তু সত্য হল সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল। এক সময়ে চোখ খুলতে হবে।

অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলি, আমরা যত কলকাতা শহর থেকে দূরে সরি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে যত নিচের মানুষের কাছে যাই, তত দেখি এই সমালোচনাগুলো সমালোচনা তো থাকেই না, ভালোবাসার বন্ধনে পরিণত হয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment