নিজের তাক লাগানো কয়েকটি সংগ্রহ বের করে দেখাচ্ছেন বৃদ্ধ গৌতম মিত্র। এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
শেষ কবে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছেন? আচ্ছা না হয় পোস্টকার্ডের কথা বাদ দিন। শেষ কবে চিঠি লিখেছেন? প্রশ্ন শুনে মাথা চুলকাতে বসে গেছেন নিশ্চয়! উত্তরে নিশ্চয় বলবেন, ডিজিটালের যুগে এসব ব্যবহারের ইচ্ছে বা সময় কারও নেই। বর্তমান সময়ে চিঠি কিংবা পোস্টকার্ড বিলুপ্তপ্রায় এক সভ্যতার নিদর্শনমাত্র। তবে তাদের বলে রাখি একটা সময় ছিল যখন এই পোস্টকার্ড ফেসবুক এবং ইন্সটাগ্রামের মতো বেশ জনপ্রিয় ছিল। সময়টা আজ থেকে প্রায় শ'-দেড়শো বছর আগের কথা, কোনও জায়গার ছবি ছাপানো পোস্টকার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময় বা খোঁজখবর নেওয়াটা ছিল দস্তুর। তাই এ দেশ থেকে পাঠানো কোনও পোস্টকার্ড যখন সাত সাগর পেরিয়ে বিলেতে শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে পৌঁছত, তখন শুধু বার্তা নয়, হাজার হাজার মাইল দূরের দেশটায় ফুটে উঠত ঔপনিবেশিক ভারতের জনজীবনের ছবিটাও। ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালের এই জিনিসগুলোয় সংগ্রহ করা গৌতম মিত্রের নেশা।
Advertisment
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
রাণী ভিক্টোরিয়ার থেকে রাজা ষষ্ঠ জর্জের সময়কাল পর্যন্ত সব ধরণের পোস্টকার্ড এবং মুদ্রা এসবই গৌতমবাবুর সংগ্রহের প্রধান বিষয়। বয়স নব্বই ছুই ছুই। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। বয়সের জন্যে বাইরে তেমন বেরোতে পারেন না। যদিও একটা সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নানা রকম কার্ড তিনি সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে যা কিছু সংগ্রহ করছেন তা ঘরে বসেই। বয়স বাড়লেও স্মৃতিরা বেশ তরতজা। গড় গড় করে বলে দিতে পারেন, পিকচার পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট, এবং মুদ্রার সমস্ত যাবতীয় ইতিহাস।
উইলিয়ামসের মৃত্যুর পর ভিক্টোরিয়ার রানী হওয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিশ্বের তাবড় তাবড় সেনা প্রধানের ছবি দেওয়া সিগারেট কার্ড। ব্রিটিশ শাসনকালের টাকা। এসবই নিজের কাছে ফাইল বন্দি করে রেখেছেন। ফাইলের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলছিলেন সংগ্রহের পিছনের গল্প। প্রায় চার হাজারের মতন পিকচার পোস্টকার্ড এই সংগ্রাহকের সংগ্রহের ঝুলিতে রয়েছে।
আর পাঁচটা সংগ্রাহকের মতো গৌতম মিত্রের সংগ্রহের শুরুটাও হয়েছিল ছোট থেকেই। গৌতম বাবুর কথায়, "আমাদের বাড়িতে সংগ্রহের পরিবেশ ছিল। ছোট থেকেই সংগ্রহ করা দেখেছি। আমার বাবা সংগ্রহ করতেন পোস্টকার্ড, আর আমার কাকা করতেন অটোগ্রাফ। সময়টা তিরিশ দশকের শেষ চল্লিশের দশকের সবে শুরু। বয়স তখন ছয় কি সাত বছর। আমার কাকাকে দেখেই আমি অটোগ্রাফের একটি খাতা তৈরি করে তাতে সই সংগ্রহ শুরু করি। এর কিছুদিন পর ডাকটিকিটও আমার সংগ্রহের তালিকায় যুক্ত হয়। অনেক পরে কয়েন সংগ্রহের দিকে আমার ঝোঁক বাড়ে। বাবার পোস্ট কার্ড সংগ্রহটা বাড়াতে গিয়েই আমার সংগ্রহ জীবন আরও দীর্ঘ পরিসরে ছড়িয়ে পরে।"
সংগ্রহের পাতা থেকে...এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এসব সংগ্রহ করার সময় আলাপ হয় একজন বিখ্যাত গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহকের সঙ্গে। রেকর্ডারের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকলে পুরনো অনেক রেকর্ডারই সংগ্রহ করে ফেলেন গৌতমবাবু। কিন্তু এই গ্রামোফোন রেকর্ডার সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজন হয় অনেক জায়গার। পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না থাকার কারণে তিনি সব রেকর্ড বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কিছু দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড যদিও এখনও তিনি রেখে দিয়েছেন নিজের কাছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপ-আমেরিকায় পোস্টকার্ডের ব্যবসা চলছিল রমরমিয়ে। ইতিহাস বলছে সে সময় বার্ষিক পোস্টকার্ড ছাপানোর সংখ্যাটা ছিল ২০০ কোটির মতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল যে কলকাতা, সেই শহরেও তখন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল এই পোস্টকার্ডের ব্যবসা। রঙবেরঙের পিকচার পোস্টকার্ডের প্রতি মানুষের আগ্রহ তখন তুঙ্গে। চারকোণা এই কাগজের টুকরোর সঙ্গে জড়িয়ে পরে ইতিহাস। উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কলকাতায় রমরমা ছিল এই বাহারি পোস্টকার্ডের। মদ বা সিগারেটের সারোগেট বিজ্ঞাপন হিসেবে এখন গানের সিডি বা বাহারি উপহারের চল রয়েছে।
সে সময়ে কলকাতার বিখ্যাত তামাক বিক্রেতা ডি ম্যাক্রোপোলা কিংবা ইতালীয় ওয়াইন কোম্পানি ফেরুজিনোসো সেরাভালো ক্রেতাদের উপহার দিতেন কলকাতার ছবিওয়ালা বাহারি পোস্টকার্ড। পোস্টকার্ড ব্যবসায় লাভের হাতছানি পেয়ে সে সময়ের অনেক বিখ্যাত চিত্রগ্রাহকও এই ব্যবসায় নামেন। ওয়ার্নার রোসলার, জনস্টন অ্যান্ড হফম্যান ছিলেন যার অন্যতম। লন্ডনের 'রাফায়েল টাক অ্যান্ড সন্স' কিংবা 'থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি'র তৈরি কলকাতা তথা ঔপনিবেশিক ভারতের ছবিওয়ালা পোস্টকার্ডও দারুণ জনপ্রিয় হয়। গৌতমবাবু প্রথম দিকে আর্টের উপর যত পোস্টকার্ড বেরিয়েছিল তা সবই সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তীতে কলকাতাকে নিয়ে বেরনো যত পোস্টকার্ড তা সংগ্রহ শুরু করেন। যা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক্সপ্রেস ফটো: শশী ঘোষ।
এসবের পাশাপাশি গৌতম মিত্রের কাছে বিখ্যাত মানুষদের সই সংগ্রহের ভান্ডারও নেহাত কম নয়। পুরনো দিনের যত খেলোয়াড় ছিলেন তাঁদের সবার সই তিনি নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছেন। নগরজীবন যেমন বদলে গেছে, তেমনই যে ছবি থেকে এই সব পোস্টকার্ড ছাপা হয়, সে ছবিও কিছু আছে, কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারানো সময়ের স্মৃতি জড়িয়ে রয়ে গেছে হাজার হাজার পোস্টকার্ড। বাকি সংগ্রাহকদের মতন গৌতম বাবুও মনে করেন, সংগ্রহ যারা করেন তাঁদের কাছে সংগ্রহেরা এমনিতেই চলে আসে। তাদের খুঁজে নিতে হয় না। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটায় হয়েছে। স্মৃতির পাতা ওলটাতে ওলটাতে ইতিহাসেরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল বৃদ্ধ এই সংগ্রাহকের কাছে। এখন বদলে গেছে কত কিছু, তবুও ইতিহাসের কাগজগুলো ভবিষ্যতের জন্যে যত্ন করে আগলে রাখছেন এই মানুষগুলোই।