চালের গ্রেডিংয়ের জন্য প্রস্তাবিত নিয়ম শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি সুগন্ধি জাতের চালের জন্য একটি পৃথক পরিচয়ের পথ প্রশস্ত করবে। তাদের বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা জায়গা দেবে। পশ্চিমবঙ্গ কৃষি বিপণন বিভাগের আধিকারিকদের মতে, কেন্দ্র 'গ্রেডিং এবং চিহ্নিতকরণ নিয়ম ২০২৩'-এর অধীনে 'সুগন্ধযুক্ত নন-বাসমতি বিভাগ' নামে একটি নতুন রফতানি গোষ্ঠী চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৃষি বিপণন বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন আধিকারিক এই প্রসঙ্গে বলেন, 'আমাদের গোবিন্দভোগ এবং তুলাইপাঞ্জির মত দেশীয় সুগন্ধি জাতের বাসমতি ধানের ক্যাটাগরিতে রফতানি করতে হত। তবে এসব চালের জাত, বাসমতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে না। বছরের পর বছর ধরে, আমরা এই জাতীয় দেশীয় শ্রেণির চাল রফতানির জন্য একটি পৃথক বিভাগ চেয়েছিলাম। এখন, কেন্দ্র 'সুগন্ধযুক্ত নন-বাসমতি বিভাগ' নামে একটি বিভাগ তৈরি করতে রাজি হয়েছে। ইতিমধ্যে, প্রস্তাবিত বিভাগের জন্য খসড়া নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেগুলো চূড়ান্ত হয়ে যাবে।'
কৃষি বিপণন বিভাগের মতে, প্রস্তাবিত 'সুগন্ধযুক্ত অ-বাসমতি বিভাগের' অধীনে পাঁচটি দেশীয় সুগন্ধি চালের জাত- গোবিন্দভোগ, তুলাইপাঞ্জি, রান্ধুনি পাগল, কাটারিভোগ এবং কালুনিয়া রফতানি করার পরিকল্পনা করেছে রাজ্য সরকার। এখন পর্যন্ত, বাসমতিই ভারতের একমাত্র ধানের জাত যার রফতানির উদ্দেশ্যে আলাদা 'হরমোনাইজড সিস্টেম নামকরণ (HSN)' কোড রয়েছে। এই বিশ্বব্যাপী কোড পণ্যের পদ্ধতিগত শ্রেণিবিভাগের জন্য ১৯৮৮ সালে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন (ডব্লিউসিও) দ্বারা চালু হয়েছিল। কৃষি বিভাগের ওই আধিকারিক আরও বলেন, 'গোবিন্দভোগ, তুলাইপাঞ্জি, রাধাতিলক, রান্ধুনি পাগল, কাটারিভোগ, কালুনিয়া, বাদশাভোগ এবং হরিণাখুরির মতো দেশি ধানের জাতগুলোর বিপুল রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, সেসব বাসমতি ধানের ক্যাটাগরিতে রফতানি করা হয়, বলে অনেকেই সেসব সম্পর্কে জানেন না।'
আরও পড়ুন- বিরতির পর বাংলায় দ্বিতীয় স্পেল খেলতে নামার অপেক্ষায় শীত, কবে থেকে?
কৃষি বিপণন বিভাগের ওই আধিকারিক বলেন, 'বাংলার নিজস্ব চালের শ্রেণিগুলির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা বাসমতি চালের মতো নয়। এখন, একটি পৃথক পরিচয় তাদের রফতানির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের উপকৃত করবে। নতুন গ্রেডিং এবং চিহ্নিতকরণের নিয়মগুলো শুধুমাত্র বাংলার জন্যই নয়, সমগ্র দেশকেও উপকৃত করবে। কারণ, প্রায় প্রতিটি ধান উৎপাদনকারী রাজ্যের নিজস্ব দেশীয় সুগন্ধি ধানের জাত আছে, যা বাসমতির মত নয়।' নভেম্বরে, কৃষি ও কৃষককল্যাণ বিভাগের বিপণন ও পরিদর্শন বিভাগ সম্প্রতি রাজ্য কৃষি বিভাগকে চিঠি লিখে উল্লেখ করেছে যে, 'অ-বাসমতি সুগন্ধি চালের জন্য 'গ্রেডিং এবং চিহ্নিতকরণ নিয়ম ২০২৩'-এর খসড়া খুব শীঘ্রই তৈরি হবে। সেকথা মাথায় রেখে পরামর্শ/মন্তব্যের জন্য অ-বাসমতি সুগন্ধি চালের গ্রেডিং এবং চিহ্নিতকরণ নিয়ম, ২০২৩ পরীক্ষা করার অনুরোধ করা হচ্ছে। এরপর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৫ দিনের মধ্যে সেই নিয়মগুলো অফিসে পাঠিয়ে জানানো হবে।
কৃষিকর্তা জানিয়েছেন, 'খসড়া বিধিমালা প্রকাশের পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা চিঠি পেয়েছি। আমরা ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাঠিয়েছি এবং নন-বাসমতি ধান বিভাগের অধীনে প্রথম জাত হিসেবে গোবিন্দভোগকে গ্রেডিং এবং চিহ্নিত করার জন্য আবেদনও করেছি। এটি অনুমোদিত হলে, আমরা ধীরে ধীরে রফতানি গ্রেডিংয়ের জন্য অন্যান্য চারটি সুগন্ধি চালের জন্য আবেদন করব। আমরা আশা করছি যে ২০২৪ সাল থেকে সুগন্ধি নন-বাসমতি চাল বিভাগে এগুলো রফতানি করতে পারব। আমরা রফতানির উদ্দেশ্যে এই জাতীয় বিভাগগুলোর বিকাশের লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করছি।'
আরও পড়ুন- বাংলায় ফের সেই সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি! কালীঘাটে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ মমতা-অভিষেককে
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময় পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিপণনমন্ত্রী বেচারাম মান্না বলেন, 'আমরা খুব খুশি যে এই সুগন্ধি জাতের চালগুলো রফতানির জন্য একটি পৃথক সত্তা পাবে। এটি আমাদের কৃষকদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে। এই উন্নয়ন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টার ফল। তিনি সর্বদা কৃষকদের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন।' বাংলার পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম এবং বাঁকুড়া জেলার চালের আলাদা বিশেষত্ব আছে। গোবিন্দভোগ ২০১৭ সালে কেন্দ্র থেকে ভৌগলিক (GI) মর্যাদা পেয়েছে। কলকাতা বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ দেবাশিস বোসের মতে, ইতিহাসের বিচারে গোবিন্দভোগ সর্বদা উচ্চআয়ের চালের শ্রেণির মধ্যে পড়ে।
দেবাশিস বোস বলেন, 'কলকাতার শেঠ-বসক সম্প্রদায়ের ইতিহাসবিদ নগেন্দ্রনাথ শেঠ তাঁর 'কলিকাতাস্থ তন্তুবণিক জাতি ইতিহাস'-এ উল্লেখ করেছেন যে তাঁদের দেবতা গোবিন্দজিকে 'ভোগ' হিসেবে উচ্চমানের চাল দেওয়া হয়েছিল। তাই এটি 'গোবিন্দভোগ' নামে পরিচিত হয়েছিল। আবার, বাঙালি লেখক দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'সুরধুনি কাব্য'-এ 'গোবিন্দভোগ'কে বর্ধমান অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় বিক্রি করা একটি দামি ধানের জাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।' পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন কৃষি কর্মকর্তা অনুপম পাল বলেন, 'গোবিন্দভোগ বাংলার একটি জনপ্রিয় সুগন্ধি ধান। প্রতিবছর রাজ্যে ৬৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি গোবিন্দভোগ কাটার জন্য ব্যবহৃত হয়। যদি গোবিন্দভোগ আলাদা মার্কিং এবং গ্রেডিং পায়, তবে এটির রফতানিতে সুবিধা হবে। কিন্তু, কৃষকরা যে এর থেকে লাভবান হবেনই, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, গোবিন্দভোগ এখন বাংলায় রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে। সেটা কিন্তু, রফতানির প্রচারে কোনও সাহায্য করবে না।'