ওমিক্রন আতঙ্কে নাজেহাল বিশ্ববাসী। পাল্লা দিয়ে যেমন একাধারে বেড়েছে সংক্রমণ সেই সঙ্গে বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এবং মৃত্যুও। একের পর ডাক্তার, নার্স স্বাস্থ্য কর্মী ওমিক্রনে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ফলে ব্যাহত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। এদিকে শিশুদের মধ্যেও থাবা বসিয়েছে করোনা ভাইরাস। সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে জলপাইগুড়ি জেলায় মৃত্যু হল ছয় দিনের এক শিশুর। ঘটনাটি ঘটেছে জলপাইগুড়ি জেলার ওদলাবাড়ি অঞ্চলে।
জানা গিয়েছে, গত ১১ জানুয়ারি ওদলাবাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে এক শিশুর জন্ম হয়। ২৪ ঘণ্টা পর মা এবং শিশুকে ছুটি দিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রবিবার শিশুটি অসুস্থ হলে তাকে ফের হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসা চলাকালীনই হাসপাতালে মারা যায় শিশুটি। মাত্র ৬দিনের মাথাতেই শিশুর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে গোটা পরিবার। পাশাপাশি চিন্তা বেড়েছে স্বাস্থ্য দফতরের। কারণ তৃতীয় ঢেউয়ে বলি হচ্ছে সদ্যোজাত শিশুরা। শিশুদের উপর তৃতীয় ঢেউয়ের রেশ ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও জানা গিয়েছে শিশুটি সেদিন সকালেই সর্দি কাশির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসে।
হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির চিকিৎসা শুরু হয়। নেবুলাইজারও দেওয়া হয়।নেবুলাইজ করার সময়ই দেখা যায় বাচ্চাটি মারা গিয়েছে। এরপর র্যাপিড টেস্ট করে জানা গেছে শিশুটি করোনা পজিটিভ ছিল। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে বাচ্চাটির আইফোগ্লাইসেমিয়া ছিল। শিশুটি ইতিমধ্যেই বুকের দুধ খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এদিকে করোনায় ৬ দিনের বাচ্চার মারা যাওয়ার ঘটনায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
এপ্রসঙ্গে প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘করোনা তৃতীয় ঢেউ কালে প্রচুর সংখ্যক বাচ্চা ওমিক্রনে আক্রান্ত হলেও ৫ থেকে সাত দিনের মধ্যে তারা সুস্থও হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে যে খুব বেশি সংখ্যক শিশুকে ভর্তি হতে হয়েছে তেমনটাও নয়। এক্ষেত্রে দেখেতে হবে শিশুটির করোনা ছাড়া আর কোন শারীরিক সমস্যা ছিল কিনা! কারণ এত ছোট বাচ্চার এভাবে করোনায় মারা যাওয়া বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। শিশুদের ক্ষেত্রে যদি তাদের শ্বাসযন্ত্রের কোন সমস্যা থাকে তবে ৬ থেকে ২৪ দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট অথবা অন্যান্য কিছু সমস্যা দেখা যাতে পারে। তা থেকে অনেক সময়ই মৃত্যু ঘটতে পারে, তবে এত বাচ্চার চিকিৎসা করেছি প্রথম ঢেউ থেকে এমন ঘটনা আগে কখনও দেখিনি। তিনি আরও বলে, আমার মনে হয় শিশুটির মা’ও সম্ভবত কোভিড পজিটিভ হয়ে থাকতে পারেন। তবে তার সঙ্গে মৃত্যুর সেভাবে কোন সম্পর্ক নেই বলেই মনে করছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ঘটনাটির প্রকৃত কারণ সামনে আসা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ’। কারণ এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম।
অন্তঃসত্ত্বাদের করোনায় ঝুঁকি কতটা, কী কী নিয়ম মেনে চলা আবশ্যিক
এদিকে এই ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন আতঙ্ক বিরাজ করছে, তেমনি অন্তঃসত্ত্বা বা যাঁরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাঁরা বিশেষভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। সন্তান ধারণ করেছেন বা করবেন, এমন নারীদের জন্য করোনার সংক্রমণ বিশেষ কোন ঝুঁকি বয়ে আনে কি না, চলুন আমরা জেনে নিই অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের কী কী বিষয় মেনে চলতে হবে! জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইন্দ্রনীল চৌধুরী।
গর্ভবতীরা কি বেশি ঝুঁকিতে?
গর্ভাবস্থায় এমনিতেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই গর্ভাবস্থায় যেকোনো ফ্লু বা অন্য কোন সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার বুক–পেটের মধ্যের ডায়াফ্রাম নামক পর্দাটি এ সময় একটু ওপরের দিকে উঠে যায় বলে স্বাভাবিকভাবেও শ্বাসকষ্ট হয় শেষের দিকে, সংক্রমণের জন্য সাধারণ মানুষের তুলনায় শ্বাসকষ্ট বেশি হতে পারে। তাই এ সময় যেকোনো ধরনের কাশি–জ্বর হলে শুরুতেই চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হলে পরবর্তী ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
মায়ের কাছ থেকে কি নবজাতক সংক্রমিত হতে পারে?
সংখ্যায় যথেষ্ট না হলেও গবেষণায় এসেছে যে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত কোন মায়ের কাছ থেকে কোন নবজাতক জন্মগত সংক্রমণ নিয়ে জন্মায়নি এখনো। গর্ভস্থ লিকুইড (এমনিওটিক ফ্লুইড) বা বুকের দুধেও এর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
আক্রান্ত মা কি বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন?
এখন পর্যন্ত বুকের দুধে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তাই আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। তবে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করে খাওয়াতে হবে। হাত ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে ও মুখে মাস্ক পরতে হবে খাওয়ানোর সময়।
কী কী মানবেন-
• আর পাঁচ জনের মতোই হ্যান্ড হাইজিন বা কাফ এটিকেট খুব ভাল করে মানতে হবে।
• হাঁচি, কাশি, জ্বর হয়েছে এমন মানুষের থেকে দূরে থাকাও বাধ্যতামূলক।
• পুষ্টিকর খাবার, যেমন শাকসব্জি, প্রোটিন বেশি করে পাতে রাখুন।
• দিনে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমনো ভীষণ দরকারি।
• অযথা দুশ্চিন্তা না করে পছন্দের কাজে সময় দিন।
• হালকা ঘরের কাজ অবশ্যই করবেন। উবু হয়ে বসে করতে হয় এমন কাজ এড়িয়ে চলাই ভাল।
কী কী করণীয়-
• সবে সবে যাঁরা গর্ভবতী হলেন, তাঁরা আগে চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে খুব দরকার পড়লে তবেই ক্লিনিকে যান।
• গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ দেখা খুব জরুরি। সে ক্ষেত্রে নিজেরাই ডিজিটাল মেশিনের সাহায্যে দেখে প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন।
• ইউএসজি স্ক্যান আর কিছু রক্তপরীক্ষা করে নিতে তো হবেই। সেটা একটু ফাঁকায় ফাঁকায় গিয়ে করাই ভাল।
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণ আছে এমন মহিলাদের নর্মাল ডেলিভারিতে খুব কিছু অসুবিধা নেই।
• করোনা সংক্রমিত কোনো রোগীর যদি কোনও কারণে সিজারিয়ান সেকশান করতেই হয় তবে সে ক্ষেত্রে স্পাইনাল অ্যানেস্থেসিয়াতেই করা উচিত। কারণ জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ার ফলে অনেক ড্রপলেট তৈরি হয় যা পুরো অপারেশন থিয়েটারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
• করোনায় আক্রান্ত মা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর যদি বুকের দুধ খাওয়ানোর অবস্থায় থাকেন, তা হলে সাবধানতা নিয়ে তা খাওয়াতেই পারেন। কিন্তু বেশি অসুস্থ থাকলে, দুর্বল থাকার কারণে বুকের দুধ এক্সপ্রেস করেও অন্য কাউকে দিয়েও শিশুটিকে খাওয়াতে পারেন। ফর্মুলা ফিড দেওয়ার চেয়ে এটাই ভাল। এটি শিশুর শরীরে ইমিউনিটি বাড়িয়ে করোনা প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
• সন্তানসম্ভবা অবস্থায় করোনার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।