কলেজের আড্ডায়, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কিংবা কোনও সঙ্গীত-সন্ধ্যায় গিটার না হলে অনেকেরই চলে না। সুর ও সঙ্গীতের যারা ভক্ত তাঁরা তো বটেই, যারা কম বেশী সঙ্গীত চর্চা রাখেন, তাদের কাছেও অবসরের অন্যতম প্রধান বিনোদন গিটার। পাশ্চাত্যে এই বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গিটারের ব্যবহার কবে থেকে হচ্ছে এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। সব থেকে বেশি যা প্রচলিত, পৌরাণিক গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর হাতে যে বর্গাকার তারের যন্ত্রটি দেখা যেত, তা থেকেই মূলত গিটারের ধারণাটি এসেছে।
এই সব তর্ক বিতর্ক দূরে সরিয়ে ঘুরে আসা যাক বাংলার গিটার গ্রামে। বাংলার একমাত্র গ্রাম যেখান পাশ্চাত্যে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয় ঘরে ঘরে। গ্রামের নাম চণ্ডীতলা কাউগাছি। সকলে চেনে গিটার গ্রাম নামে। প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে হচ্ছে গিটার। গিটারের সুর শোনা না গেলেও, কিন্তু চারিদিকে গিটার তৈরির শব্দ কানে আসবেই।
উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগর কাউগাছি চন্ডিতলা এলাকায় একাধিক গিটার কারখানা অবস্থিত। রাস্তার ডান-বাম চারিদিকেই শুধু গিটার তৈরির সরঞ্জাম। কিভাবে তৈরি হয় এই সুরেলা বাদ্যযন্ত্র! এখনকার গিটার পৌঁছে যাচ্ছে রাজ্যের পাশাপাশি দেশ পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এই সব দেশেই এই বাংলার এই গ্রামের গিটারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এই গ্রামেই একটি গিটার কারখানার মালিক খোকন রায়। গত ২০ বছর ধরে তিনি গিটারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। "আগে দমদমে সব থেকে বেশী গিটার তৈরি হত, গিটারে রং এবং পালিশের কাজ হত। এরপর আস্তে আস্তে মজুরেরা নিজেরাই গিটার তৈরি শিখে যায়। একজনের থেকে আরেকজন প্রত্যেক এভাবে গোটা গ্রামে গিটার তৈরি শুরু হয়ে যায়।" বলছিলেন খোকন রায়।
বছর পঁয়ত্রিশের বাবু মন্ডল, গিটার শ্রমিক। তার কথায়, "আগে গ্রামের ছেলেরা বাইরে কাজে যেত। গিটার কারখানাগুলো গ্রামে তৈরি হওয়ার পর থেকে সকলে গ্রামে থেকেই ভালো উপার্জন করতে পারছে। গ্রামের মানুষের এই বাদ্যযন্ত্র তৈরির ব্যাপারে কোনও ধারণা ছিলনা এখন সকলে জেনে গিয়েছে। বিদেশী বাদ্যযন্ত্র গিটার এখন গ্রামের মানুষও তৈরি করতে জানে।"
গিটার অনেক ধরনের হয় তবে এই এলাকায় মূলত ৫-৬ ধরনের গিটার বেশি হয় অর্ডার অনুযায়ী। একটা গিটার তৈরি করতে প্রায় ৭ দিন সময় লাগে। আসামের ঘোড়ানিম কাঠ তৈরির জন্যে নিয়ে আসা হয়। এরপর গিটার তৈরির প্রথম ধাপ শুরু হয় নেক তৈরির মাধ্যমে। সেটি সঠিক সাইজে কেটে পৌঁছে যায় ফিটিংস এর ঘরে। অন্যদিকে, বিভিন্ন শেপে তৈরি হয় প্রধান বডি। বডি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর, দুপাশে প্লাই দিয়ে আঠা লাগিয়ে নাট বোল্ট দিয়ে আটকে রোদে শোকানো হয়। তারপর চলে ফিটিংস অর্থাৎ বডির সাথে নেক এর জয়েন্ট করার কাজ। সেটা সম্পূর্ণ হলেই, চলে যায় পালিশের ঘরে। সেখানে রং ও পালিশ হয়ে চলে আসে মেইন ঘরে। এখান থেকেই গিটারে সুর বাধার কাজ শুরু হয়। স্ট্রিং(তার) ফিটিংস করা হয় এখানেই। তারপর গোটা গিটার তৈরি হয়ে প্যাকিং হয়ে অর্ডার অনুযায়ী চলে যায় বিভিন্ন প্রান্তে।
লোকাল কাস্টমার তুলনায় বাইরে থেকেই বেশীরভাগ এসে এই গিটার গ্রাম থেকে পছন্দ করে গিটার কিনে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ বিদেশের ব্যবসায়ীরা এখানের কারখানাগুলো থেকেই পাইকারি দরে গিটার অর্ডার করেন। গিটার পছন্দ হলে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। গিটার শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, এটি এক একটি সংস্কৃতির পরিচায়কও বটে। গ্রামের সাথে শহরের এত সুন্দর মেলবন্ধন সম্ভব হয়েছে একমাত্র এই গিটারে মাধ্যমেই। গোটা গ্রামেই যেন সারাদিন ভেসে বেড়ায় সুরের প্রতিধ্বনি।