A School For One Rupee: টুনিঘাটা গ্রাম। এই গ্রামের পাড়ুইপাড়া এলাকার বেশিরভাগ মানুষই জেলে এবং দিনমজুর। একটা সময় পর্যন্ত এই গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েরাই ছিল স্কুলছুট। জীবিকা নির্বাহের জন্যে ছোট থেকে বেছে নিতে হত মাছ ধরা এবং পরিচারিকার কাজকে। মুখে দু-মুঠো ভাত তুলতে গিয়েই যাদের রোজ হিমশিম খেতে হয়, তাদের এছাড়া উপায় কি! এর মধ্যে আবার পড়াশুনা! নেহাত বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াশোনা করানোর সামর্থ্য কোথায়? এইসব শিশুদের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্যেই লড়াই শুরু করেছিলেন সঞ্জীব কাঞ্জিলাল। প্রত্যন্ত গ্রামের মেহগনি গাছতলায়। এখানেই রয়েছে তাঁর পাঠশালা। যেখানে পাখির ডাক কানে ভেসে আসে। যতদূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। ডিঙ্গি নৌকোয় মাছ ধরে জেলে। এর মাঝে কিছু ছেলেমেয়েরা আওড়ে যায়, 'পাখি সব করে রব…'।
এখান বসেই সঞ্জীব বাবু মানুষ গড়ার কারখানা চালান। ক্লাস হয় এখানে নিয়ম করে। পড়ার ফাঁকে একসঙ্গে চলে নাচ, গান। গলা খুলে পাঠ করা হয় ছড়া, কবিতা। এঁকে ফেলা হয় রং-বেরঙের ছবি। শহরের ইট-কাঠ, পাথরের জঙ্গল থেকে অনেক দূরে। সবার অলক্ষ্যে। তাঁর রোজকার কর্মকাণ্ডের সাক্ষী শুধু বিশাল বিশাল গাছেরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছেন বিশাল এক ব্রহ্মাণ্ড। যারা আগামী প্রজন্মের পথ প্রদর্শক।
সঞ্জীব কাঞ্জিলাল পেশায় নাবিক। মার্চেন্ট নেভিতে কর্মরত। পাঠশালার শুরুটা করেছিলেন বছর চারেক আগে। ২০২০ সালে। তখন লকডাউন আর মহামারীতে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার টুনিঘাটা এলাকার কয়েক জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে শুরু করেন এক অভিনব পাঠশালা। গাছতলার নীচে। খোলা পরিবেশে বসেই হয় পড়াশুনা। সেই থেকে শুরু। এরপর যত দিন যাচ্ছে, কলেবরে বাড়ছে সেই পাঠশালা। গাছতলায় পড়ুয়ার সংখ্যা বর্তমানে ৩৭ জনের মতন। খোলা আকাশের নীচে চটের বস্তা পেতে বসে পড়ুয়ারা। গাছের সঙ্গে বাঁধা থাকে বোর্ড। এর মধ্যেই চলে একের পর এক ক্লাস। নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে চলে আলাপ-আলোচনা। এ যেন আদি অকৃত্রিম গ্রামীণ আবহে মানুষ গড়ার কর্মযজ্ঞ চলছে। সঞ্জীবের কথায়, "করোনার সময় আমরা এই পাঠশালা শুরু করি। ২৬ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। পড়াশুনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝানোর জন্যে প্রথম দিকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এখানের পাড়ুইপাড়ার বেশিরভাগ লোকেরাই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে, ছেলে মেয়েরাও সকাল হলে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ত এলাকার বৃহৎ নাংলাবিল বিলে। পড়াশোনা করতে চাইত না। করোনার সময় এদের কথা ভেবেই আমরা পাঠশালা শুরু করি। পড়াশোনা ফাঁকে সাধ্যমতো টিফিন দেওয়া হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে খেলাধুলা, নাচ, গান সবই। এতে বাচ্চারা খুশি হয়। আগ্রহ বাড়তে থাকে। সকলেই আমার কথা শোনে। আমায় ভালোবাসে। এখন আমাদের এখানে আর কেউ স্কুলছুট নেই।"
শুধু পড়াশোনাই নয়, তার পাশাপাশি ছবি আঁকা, নাটক, নাচ, গান সব কিছুই শিখছে এই গ্রামীণ পাঠশালার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। করোনা পর্বে তৈরি হওয়া এই পাঠশালার নাম এখন গ্রামের সকলের মুখে মুখে- 'এক টাকার পাঠশালা'। উদ্দেশ্য, একটাই, কেউ যেন স্কুলছুট না হয়। ছেলেমেয়েদের থেকে নেওয়া হয় মাত্র ১ টাকা। এই দিয়েই চলে এতসব! কিন্তু এই এক টাকা নেওয়ার প্রয়োজনই বা কেন? সঞ্জীব কাঞ্জিলাল হাসতে হাসতে বলছিলেন এক টাকা নেওয়ার পিছনের কারণ, "ওই টাকাটা আসলে হল গুরুদক্ষিণা। আমার এখানে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের পড়াশোনা করানো হয়। পড়ার পাশাপাশি আবৃত্তি, আঁকা, তবলাও শেখানো হয়। সকাল ৭টা থেকে বেলা ৯.৩০টা পর্যন্ত পড়াশোনা চলে। একটি মেহগনি গাছের বাগানে বসে চলে পাঠশালা। ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে বস্তা আনে পেতে বসার জন্য। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও চট-মাদুর পেতে বসেন। ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলে গাছের ডালে। কোনও ছাত্র-ছাত্রী যদি তিন দিনের বেশি পড়তে না আসে, তবে আমরা তাদের বাড়ি যাই। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। আর্থিক সমস্যা থাকলে আমরা আমাদের সাধ্য মতন সাহায্য করার চেষ্টা করি। বোঝানোর চেষ্টা করি, পড়াশুনা ছাড়া ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একটাই লক্ষ্যে, শিক্ষার আলো সবার মধ্যে যেন ছড়িয়ে দিতে পারি।" সঞ্জীববাবুর পাঠশালাতে, স্থানীয়রা তো বটেই আশেপাশের গ্রামের অভিভাবকরাও তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাতে চান। কিন্তু সকলকে সামলাতে যে আর্থিক সঙ্গতি দরকার, তা আছে কই!
আরও পড়ুন- লোকসভা ভোট ঘোষণার আগেই বড় চমক বিজেপির, প্রার্থী ঘোষণা, বাংলার কোন কেন্দ্রে কে?
"আমি যা বেতন পাই তার বেশিরভাগটাই দিয়ে দিই এই পাঠশালাতে। বছরের অর্ধেক সময় চলে যায় সমুদ্রে। নিজের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্যে বই খাতা পোশাক যা যা লাগে, তা সব কিনি। সাধ্যমতো সাহায্য করেন এলাকার কিছু মানুষ। সরকারি কোনও সাহায্য পাই না। এখন সরকারি বা বড় আকারের আর্থিক সাহায্য যদি পাই, তবে চিন্তা-ভাবনা আছে, আরও সুন্দর করে আমার এই পাঠশালা সাজানোর। এখানে এলে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার প্রতি আরও আগ্রহ বাড়বে।" দুঃখ করে বলছিলেন সঞ্জীববাবু। তাঁকে এই কাজে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে এলাকারই কয়েকজন তরুণ তরুণী। এই পাঠশালায় শুধু শিশুরা নয়, শিশুদের পাশাপাশি নিরক্ষর মায়েদেরকেও সাক্ষর করে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ যেন নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান। বাঁধাধরা পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও যে আরও অনেক কিছু রয়েছে, সে সবই যেন শেখানো হয় এক টাকার পাঠশালায়। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ টপকে খোলা আকাশ আর গাছের নীচেই বসে সমাজ তৈরি করা যায়। দরকার হয় শুধু ইচ্ছের। যা সঞ্জীব কাঞ্জিলালের রয়েছে। শিক্ষার আলো দিয়েই যেন দূর করতে চাইছেন যত অন্ধকার।