এক অর্থে অসাধ্য সাধনই করে ফেলেছেন হলদিয়ার বিসি রায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। হতদরিদ্র শবর যুবকের জটিল অপারেশেনর ঝুঁকি নিতে রাজিই হয়নি তাবড় হাসপাতাল। তবে অস্ত্রোপচারের পর তাঁকেই এখন নতুন করে বাঁচার আশা জুগিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের শিল্প শহরের এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা। রাজ্য সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যসাথী কার্ডেই যুবকের চিকিৎসার পুরোটাই হয়েছে নিখরচায়।
রাজ্যের একের পর এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঘুরেও লাভ হয়নি। কেউই ঝুঁকি নিয়ে বছর কুড়ির মলয় মল্লিক নামে ওই যুবকের মুখের টিউমারের অপেরাশন করাতে রাজি হয়নি বলে দাবি পরিবারের। এমনকী ওই যুবককে নিয়ে তাঁর পরিবার ভুবনেশ্বরের এইমস থেকেও ঘুরে এসেছে। সেখানেও নাকি অস্ত্রোপচারের ঝুঁকির কথা জানিয়ে হাত গুটিয়ে নেন চিকিৎসকরা। শেষমেশ সরকারি হাসপাতালের দরজায়-দরজায় ঘুরে লাভ না হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ওই হতদরিদ্র শবর যুবক।
তবে হলদিয়ার ড. বিসি রায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই হল অসাধ্য সাধন। যুবকের মুখের ওপর বলের আকারের একটি টিউমারের জটিল অপারেশন করে তাঁর প্রাণ বাঁচালেন চিকিৎসকরা। অপারেশনের এক সপ্তাহ পর ওই যুবক এবার বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মলয় মল্লিক নামে ওই যুবকের জীবন-কাহিনী খানিকটা গল্পের মতো। সংসার বলতে বাবা ও মা। বছর সাতেক আগে তাঁর বাবা আগুনে পুড়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। গ্রামে অন্যের বাড়িতে মজুরি খাটেন মা-ছেলে। পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর ১ নং ব্লকের গোপালীতে তাঁদের খড়ের ছাউনির ছোট একচালার বাড়ি। নুন আনতে পান্তা ফুরোনর সংসার বলা চলে। মুখের ওপর ফুটবলের সাইজের একটি টিউমার নিয়েই রোদে পুড়ে জলে ভিজে কাজ করতেন ওই যুবক। মাথায় ৪০-৫০কেজি ওজন নিয়ে রাজমিস্ত্রীর হেল্পারের কাজও করেছেন তিনি। টিউমার ঢেকেছিল তাঁর ডান চোখ ও নাক।
আরও পড়ুন- চড়ছে পারদ, দক্ষিণবঙ্গে এবারের গরমে মাত্রাছাড়া ভোগান্তি? জানুন লেটেস্ট আপডেট
এরই মধ্যে একদিন শুরু হয় অসহ্য যন্ত্রণা। তবে কাজ না করলে ভাত জুটবে না! প্রবল যন্ত্রণা সয়েও দিনর পর দিন মুখ বুজে পেটের দায়ে লোকের বাড়ি মজুরি খেটে গিয়েছেন এই শবর যুবক। তবে শেষে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর গতি ছিল না। এক্ষেত্রে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর এই টিউমারের অস্ত্রোপচার অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল বলে জানিয়েছিলেন তাবড় হাসপাতালের প্রখ্যাত চিকিৎসকরা। অস্ত্রোপচারে তাঁর মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। খোদ চিকিৎসকদের মুখ থেকে এমন কথা শুনে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ওই যুবক।
একে টাকা পয়সা নেই, তাঁর চিকিৎসার বিপুল খরচ কে দেবে? মজুরি থেকে জমানো আড়াই হাজার টাকা ও স্বাস্থ্যসাথী কার্ডই ছিল সম্বল। হলদিয়ার ঠিকানা দিয়েছিল তাঁর বাড়ির পাশের লোকজনই। শেষমেশ হলদিয়ার বিসি রায় হাসপাতালের চিকিৎসকরাই সাক্ষাৎ ভগবান রূপে দেখা দিলেন তাঁর কাছে।
স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের দৌলতেই চোখ ও নাকের উপর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে ওঠা টিউমারের জটিল অপারেশনে প্রাণ বাঁচল গরিব শবর যুবকের। প্রায় দু'লক্ষ টাকার অপারেশন হল বিনা খরচে। বিসি রায় হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ৬ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন মলয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি অপারেশন করেন চিকিৎসকদের একটি টিম। মেডিক্যাল কলেজের সুপার ইএনটি বিশেষজ্ঞ বিধান রায়ের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি চিকিৎসক দল ওই অপারেশন করেন। সেই দলে ছিলেন শল্য চিকিৎসক সুকুমার মাইতি, ইএনটি বিশেষজ্ঞ রত্নদীপ ঘোষ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ সমীর বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তু মাজি, অপালা লাহিড়ি, সুমাংশু চক্রবর্তী প্রমুখ।
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার বিধান রায় বলেন, 'এটি একটি হিউজ ডেন্টিজেরাস সিস্ট। বাড়তে বাড়তে চোখ ও নাক ঢেকে ফেলেছিল ফুটবলের আকারের ওই টিউমার। টিউমারের ধাক্কায় ডান চোখ ব্রেনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। ব্রেন ও চোখের মাঝখানের পর্দা প্রায় ফেটে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তারপরই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও ৬ মাস সময় লাগবে মুখের আকৃতি পুরনো অবস্থায় ফিরতে। তারপর আর একটি কসমেটিক সার্জারি করা হবে।'