শুরুতে কম বেগ পেতে হয়নি। তবে শেষমেশ তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে ধর্মের কারবারিদেরও। তারপর থেকে আর থেমে থাকেননি নূর মহম্মদ। সেই ছোট বয়স থেকে আজ প্রৌঢ় বয়সেও গড়ে চলেছেন দেবীমূর্তি। তাঁর হাতে তৈরি মা দুর্গার চিন্ময়ী রূপে মোহিত গোটা তল্লাট। বছরের পর বছর ধরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মণ্ডপে-মণ্ডপে নূর মহম্মদের হাতে তৈরি দুর্গা মূর্তির কদর এখন অসীম।
শিশুমনের খেয়ালেই একদিন কাদা মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রতিমা। কখনও আবার স্কুলে যাওয়া-আসার পথে এলাকার পুকুরে বিসর্জন দেওয়া প্রতিমার খড়ের মেড় দেখতে পেলেই তা তুলে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। খেলার ছলেই খড়ের গায়ে কাদামাটি লেপা শুরু করেছিলেন নূর মহম্মদ চৌধুরী। নেহাতই ছেলেবেলার ভালোবাসার সেই খেলাই আজ তাঁর জীবিকা নির্ধারণের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। হলদিয়ার আন্দুলিয়ার বছর পঞ্চান্নর নূর মহম্মদ পেশায় মৃৎশিল্পী।
বর্তমানে স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভরা সংসার নূর মহম্মদের। এলাকায় শিল্পী হিসেবেও যথেষ্ট নামডাক তাঁর। হলদিয়ার বড়-বড় মণ্ডপে শোভা পায় তাঁর হাতে গড়া দুর্গাপ্রতিমা। কিন্তু শুরুর দিনগুলি এতটা সহজ ছিল না। বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় একা একা শুরু করলেও তিনি মূর্তি গড়ার প্রথাগত প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন ঈশ্বর রাধাকৃষ্ণ সামন্তের কাছে। তারপর শুরু করেন নিজের ব্যবসা।
নিজে থেকে মূর্তি গড়া শুরু করতেই প্রথমটায় রোষানলে পড়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় কিছু ধর্মভীরু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনের। এমনকী নূর মহম্মদের বিরুদ্ধে রীতিমতো ফতোয়া জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয়, যে মুসলিম হয়ে হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি তিনি গড়তে পারবেন না। কিন্তু এতে হার মানেননি নূর, বরং যত বাধা আসতে থাকে ততই তিনি ডুবে যেতে থাকেন মূর্তি গড়ার কাজে।
আরও পড়ুন- সিকিমের বিপর্যয়ে আচমকাই নিখোঁজ, পরে মর্মান্তিক পরিণতি! শোকে পাথর জওয়ানের পরিবার
একটু একটু করে নাম হতে শুরু করে তাঁর। পাশাপাশি চলতে থাকে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের বাধার সঙ্গে লড়াই। এক সময় মুসলিম সমাজের বয়কটের মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। এমনকী সামাজিক বয়কটের কারণে মা নূরজাহান বিবির মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দিতে হয় বাড়ির পাশের লাগোয়া জমিতেই। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি। সেখানেও ছিল বাধা। কিন্তু পাশে পান শ্বশুরমশাইকে। তাই নিজের বাড়িতে নয়, তাঁর বিয়ে হয় শ্বশুরবাড়িতেই।
আরও পড়ুন- রোদ ঝলমলে আকাশে উৎসবের ভরপুর আমেজ! পুজোর ঠিক আগে আগে নতুন করে দুর্যোগ?
এখন মূর্তি গড়ার কাজে পাশে পেয়েছেন নিজের স্ত্রী এবং ছেলে রাজুকেও। নূর মহম্মদের কথায়, "সারা বছর ধরে মূর্তি গড়লেও পুজোর সময়েই ব্যস্ততা প্রবল হয়ে ওঠে। আমার গড়া মূর্তি যায় জেলার বিভিন্ন মণ্ডপে। হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি গড়লেও নিজের ধর্মকে কখনও অবহেলা করিনি। নিয়ম করে নামাজ পড়েছি। কাজের চাপে রমজানের রোজা রাখতে না পারলেও নিয়মিত মসজিদে যাই।" নূর মহম্মদের স্বপ্ন মানুষ সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে ভালোবাসবেই। আর সেই স্বপ্নপূরণে নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়েও তিনি দিয়েছেন হিন্দু বাড়িতেই।