মোবাইল নেটওয়ার্কে ফোরজির (4G) পর এসে গিয়েছে ফাইভজি (5G) প্রযুক্তি। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনকার স্মার্ট ফোনের যুগে যাবতীয় লেখালেখিতেও লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া । তবুও সেই পথে না-গিয়ে প্রতি কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমায় হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে আসছেন একদল সাহিত্যপ্রেমী। তা-ও আবার এক-আধ বছর ধরে নয়। সেই সুদূর ১৯৪৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে হাতে লেখা ব্যতিক্রমী ‘প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা’। পূর্ব বর্ধমানের রায়না থানার অখ্যাত গ্রাম আনগুনার এমন বিখ্যাত সাহিত্য চর্চার খ্যাতি ইতিমধ্যেই জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের সাহিত্যিক মহলে ভালো সাড়া ফেলেছে।
আনগুনা গ্রামের 'প্রভাত স্মৃতি সংঘের’ সাহিত্যপ্রেমী সদস্যদের ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রকাশিত হয়ে আসছে এই সাহিত্য পত্রিকা। নামী-দামি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিবছর ঝাঁ-চকচকে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে পাঠকদের নজর কাড়ে। কিন্তু, আনগুনা গ্রামের হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকার কদর আজও নিজ গুণেই অটুট রয়েছে। বছর যত গড়াচ্ছে, ততই বাংলা সাহিত্য দুনিয়ায় বেড়ে চলেছে 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা'র পরিচিতি ও খ্যাতি।
কেমন এই সাহিত্য পত্রিকা, যা নিয়ে সাহিত্যিক মহলে এত হইচই? উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আট ইঞ্চি বাই বারো ইঞ্চি মাপের প্রভাত সাহিত্য পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা থাকে ২০০-রও বেশি। তাতে থাকে রং-বেরঙের আঁকিবুকি। নামজাদা কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে একেবারে নবাগতদের হাতে লেখা কবিতা ও গল্পগুচ্ছ স্থান পায় এই সাহিত্য পত্রিকায়।
পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আনগুনা গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, ১৯৪৭ সালে আনগুনা গ্রামের কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ প্রথম এই সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার পর থেকে একই ধারায় চলে আসছে এই সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ। এই সাহিত্য পত্রিকাই এখন আনগুনা গ্রামের ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে।
গ্রামবাসীরা জানালেন, প্রতিবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সন্ধ্যায় গ্রামের মন্দিরে লক্ষ্মীদেবীকে সাক্ষী রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় 'শারদীয়া প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা’। এবছরও রবিবার লক্ষীপুজোর দিন সন্ধ্যায় হাতে লেখা 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা'র ৭৬তম সংখ্যা প্রকাশিত হবে। যার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শনিবার থেকেই শুরু করে দিয়েছেন ক্লাব সদস্যরা।
রাজ্যের শস্যগোলা বলে পরিচিত পূর্ব বর্ধমানের রায়নার প্রত্যন্ত গ্রাম আনগুনা। কৃষি সমৃদ্ধ এই গ্রামের বাসিন্দাদের আরাধ্য দেবী হলেন লক্ষ্মী। কোজাগরী পূর্ণিমায় এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পূজিতা হন ধনদেবী। গ্রামের মূল মন্দিরেও লক্ষ্মীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। কর্মসূত্রে বছরের অন্য দিনগুলোতে এই গ্রামের অনেককেই বাইরে কাটাতে হয়। তবে, সারা বছর যে যেখানেই কাটান না-কেন, লক্ষ্মীপুজোর আগে সবাই ফিরে আসেন গ্রামে। তাঁরা সবাই মাতোয়ারা হন ধনদেবীর আরাধনায়। লক্ষ্মীদেবীকে সাক্ষী রেখে প্রকাশিত হওয়া 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা’ আনগুনা গ্রামের ঐতিহ্যকে সুদূরপ্রসারী করে তুলেছে।
পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আনগুনা গ্রামের বাসিন্দা অমিত রায় জানিয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম, কালীদাস রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, সত্যজিৎ রায়-সহ খ্যাতনামা লেখক ও সাহিত্যিকদের লেখনিতে সমৃদ্ধ হয়েছে 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা'। আগে এই সব লেখকদের নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিও প্রকাশিত হয়েছে এই সাহিত্য পত্রিকায়। অমিতবাবু আরও জানান, শুধু বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের লেখাই এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, এমনটা নয়। আনগুনা-সহ আশপাশের গ্রামের সাহিত্যপ্রেমী তরুণ-তরুণীদের লেখা কবিতা, গল্প- সবই গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে।
আরও পড়ুন- ফের বিপত্তি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেনের, মাঝপথে চাকা জ্যাম, যাত্রী উদ্ধারে গেল শতাব্দী
লক্ষ্মীপুজোর অনেক আগে থেকেই শুরু হয় 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা' প্রকাশনার কাজ। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, লেখক ও সাহিত্যিকরা যে যে লেখা পাঠান, তা কোনও ছাপাখানায় পাঠান হয় না। কমপিউটারে টাইপ করেও লেখা হয় না। পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্বে থাকা সদস্যরা নির্দিষ্ট মাপে কাটা আর্ট পেপারের ওপর তা লেখেন। শুধু লেখাই নয়, শিল্প নৈপুণ্যতার মাধ্যমে ওই লেখনিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয় রং ও তুলির আঁকি-বুকিতে। দীর্ঘদিন ধরে এই ভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসা সাহিত্য পত্রিকাগুলো সযত্নে সাজানো রয়েছে ক্লাবের আলমারিতে। যা অক্ষত রাখতে সারা বছর তৎপরতা চালিয়ে যান ক্লাব সদস্যরা।
অক্লান্ত পরিশ্রম করে এবছরের পত্রিকা প্রকাশনার কাজ সম্পূর্ণ করেছেন আনগুনা গ্রামের একঝাঁক তরুণ-তরুণী। এই গ্রামের রিতম বন্ধু, সায়ন বারিক, সংগীতা বন্ধু, শিল্পা কারফা, দীপঙ্কর রায়রা জানিয়েছেন, ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের হাত ধরে মুদ্রণ শিল্পে যতই উন্নতি ঘটুক না-কেন, তাঁদের হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকার আভিজাত্যটাই আলাদা। সৌমেন্দু চক্রবর্তীর বক্তব্য, 'প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা বাংলার সনাতন সাহিত্যচর্চার ভাবনাকে সমাদৃত করে রেখেছে। মুদ্রণ শিল্পে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া যাই লাগুক না-কেন, তাঁদের হাতে লেখা প্রভাত সাহিত্য পত্রিকা বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে।'