Advertisment

ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, রথযাত্রায় এগাঁয়ের হিন্দু-মুসলিম মিলে মিশে একাকার

রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির এক টুকরো ছবি ধরা পড়ে বাংলার এ তল্লাটে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Hindu and Muslim communities participated in the Rath Yatra festival in selimabad

গ্রামের ভগ্নপ্রায় মন্দিরের পাশে দাঁড়ানো রথ। ছবি: প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়।

রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির এক টুকরো ছবি ধরা পড়ে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের সেলিমাবাদে। হিন্দুদের পাশাপাশি এগাঁয়ের মুসলিম সমাজের অনেকেই রথের রশিতে টান দেন। দশকের পর দশক ধরে এভাবেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসবের আনন্দে গা ভাসাচ্ছেন এগাঁয়ের আট থেকে আশি। তবে অন্য জায়গার মতো রথের দিনে নয়, সেলিমাবাদে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় প্রকৃত উৎসবের পরের দিন, অর্থাৎ আগামিকাল। এটাই এ গ্রামের রীতি।

Advertisment

পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতে একটি প্রাচীন এলাকা সেলিমাবাদ। কথিত আছে, সম্রাট সেলিম খান এই গ্রামে নাকি আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটি সেলিমাবাদ নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাস এই গ্রামে। গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায় রয়েছে 'বাল গোপাল জিউ'-এর প্রাচীন মন্দির। সেই মন্দিরেই রথযাত্রা-সহ হিন্দুদের অন্য দেবদেবীর পুজোপাঠ হয়।

জানা যায়, সম্রাট সেলিম খান আরামবাগ থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন। দামোদরের বাঁধ ধরে যাওয়ার সময়ে পথে তাঁদের গ্রামের 'বাল গোপাল জিউ'-এর মন্দির সংলগ্ন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। পরে পাকাপাকিভাবে তিনি সেখানেই তাঁর 'আস্তানা' গড়ে তোলেন। সেলিম খানের নাম অনুসারে পরবর্তী কালে গ্রামটি 'সেলিমাবাদ' গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

জামালপুর থানা এলাকার বাসিন্দা তথা ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব গবেষক পূরবী ঘোষ জানিয়েছেন, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সেলিমাবাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রবাদ রয়েছে, এই গ্রামের সম্রাট সেলিম খান খালি হাতে বাঘ নাকি মেরেছিলেন। পূরবী ঘোষ আরও জানান, ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে শের আফগানকে হত্যা করার পর তাঁর পত্নী মেহেরুন্নিসাকে সেলিমাবাদ গ্রামের দুর্গে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেলিম খান। পরবর্তী কালে এই মেহেরুন্নিসাই নুরজাহান নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- ইসকনের রথের রশিতে টান মুখ্যমন্ত্রীর, রঙিন উৎসবে সামিল সোহম-নুসরতরাও

একইভাবে সম্রাট হওয়ার পর সেলিম খান পরিচিত হয়েছিলেন 'সম্রাট জাহাঙ্গীর' নামে। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে পূরবী ঘোষ আরও বলেন, 'আগে সেলিমাবাদ গ্রামে হিন্দু ও জৈন এই দুই ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল। সেই থেকে সেলিমাবাদ গ্রামটি বহু সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে।'

এই সেলিমাবাদ গ্রামে 'বাল গোপাল জিউ'-এর মন্দির তৈরির পিছনেও রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস। কথিত আছে , সেলিমাবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য ও তার স্ত্রী দয়ালময়ী দাসী। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শক্তিপদ সাঁতরা বলেন, ''১৯১৮ সালের আগে কোনও এক সময়ে সেলিমাবাদ গ্রামে এসে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য। বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য এই গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই মন্দির গড়ে তোলেন। সেই মন্দিরেই তিনি রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহের পুজোপাঠ শুরু করেন।''

তিনি আরও বলেন, ''তিথি অনুযায়ী গোটা দেশ জুড়ে হওয়া রথ উৎসবের পরের দিন সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রা উৎসবের সূচনা দ্বীজবরদাস বৈরাগ্যই করেছিলেন। সেই প্রথা মেনে আজও রথের পরের দিন রথের পুজোপাঠ সম্পন্ন করে আসছে সেলিমাবাদের বাল গোপাল জিউ সেবা সমিতি।''

আরও পড়ুন- শুভেন্দুর কনভয়ে ধাক্কা ট্রাকের, দুমড়ে-মুচড়ে গেল গাড়ি

শক্তিপদ সাঁতরা বলেন, ''পুরীর রথে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়। রথের দিন এই তিন দেবতার বিগ্রহ রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের মাসির বাড়িতে। কিন্তু সেলিমাবাদ গ্রামের রথে রাধাকৃষ্ণের পাথরের মূর্তি এবং অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তির পুজো হয়। তিথি মেনে দেশজুড়ে হওয়া রথযাত্রা উৎসবের পরের দিন সকাল থেকে সেলিমাবাদ গ্রামের ’বাল গোপাল জীউ’ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ ও গোপালে
পূজোপাঠ শুরু হয়। ভক্তদের প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ শেষে বিকালে কাঠের তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রথে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও গোপাল মূর্তি চাপিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দামোদরের ধারের মাসির বাড়িতে। মাসির বাড়িতে যাওয়ার পথে এই গ্রামের রথে রশিতে টান দেন সব ধর্মের মানুষজন।''

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মায়া সাঁতরা জানান, শুধুমাত্র রথযাত্রার পুজোপাঠই নয়। দোল, শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী এমনকী রাস উৎসবও তিথির নির্দিষ্ট দিনে সেলিমাবাদ গ্রামে পালিত হয় না। হয় তার পরের দিন। পুরাকাল থেকেই সেলিমাবাদ গ্রামে এমন রীতি-রেওয়াজ মেনে যাবতীয় পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে বলে মায়াদেবী জানিয়েছেন।

West Bengal East Burdwan Rath yatra Rath Yatra 2022
Advertisment