এখানকার কালীমাতা নির্জনতা পছন্দ করেন। তাই মন্দির চত্বরে বিশেষ আলো থাকে না। বাজে না মাইক্রোফোন বা লাউডস্পিকার। গোটা এলাকাতেই একটা গা ছমছমে পরিবেশ। সন্ধের পর ওই মন্দির চত্বরে খুব একটা মানুষজনও ঘেঁষেন না। হুগলির শ্রীপুরের বৈদ্যবাড়ির কালীপুজো এমনই।
হুগলি-বাঁকুড়ার সীমানা ঘেঁষা শ্রীপুর গ্রামটি শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান কামারপুকুরের মধ্যেই পড়ে। ৩০০ বছরেরও আগে রামতারক গুপ্ত এই পুজোর প্রচলন করেন। রামতারক ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক। কামারপুকুরের সবচেয়ে পুরোনো এই কালীপুজো। এই কালীমূর্তিকে কেন্দ্র করে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর গল্প। মা এখানে চামুণ্ডারূপিনী। বিশালাকার মূর্তির মাকে এখানে কোমরে এবং পায়ে বেড়ি দিয়ে রাখা হয়। বছর দশেক আগেও লোহার শিকল ব্যবহার হতো। তবে এখন প্রতীকী-রূপে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকেন মা। কিন্তু কেন? এই কালীপুজো বর্তমানে দুই শরিক মিলে পালা করে পালন করে থাকেন। কখনও পুজোর দায়িত্ব থাকে গুপ্ত পরিবারের কাঁধে কখনও আবার পুজোর দায়িত্ব সামলায় সেনগুপ্ত পরিবার।
সেনগুপ্ত পরিবারের এক সদস্য বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত জানান, তাঁরা পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছেন এককালে প্রচুর বলি হতো কালীপুজোর সময়। তখন নাকি দেবীপ্রতিমা কাঁপতো। মনে হতো তিনি বেরিয়ে আসবেন মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে। তাঁকে আটকানোর জন্যই লোহার বেড়ি পড়ানো হতো। এই চামুণ্ডা মাকে ভক্তির সঙ্গে ভয়ও করেন অনেকে। বিশ্বাস, মা কূপিত হলে পরিবারে ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেনগুপ্ত পরিবারের ওই সদস্যের মতে, এখানকার দেবী মাতা খুবই জাগ্রত। এই মায়ের কাছে মানত করে বিফলে ফেরেনি কেউ। এমনটা মনে করেন স্থানীয়রাও।
এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন, মাকে ভয় করার যথেষ্ট কারণও আছে। এই মায়ের কাছে লাল পাড় শাড়ি এবং নুপুর, আলতা পড়ে পুজো দেওয়া নিষেধ। মা নাকি তাতে অসন্তুষ্ট হন। আর মা যদি রেগে যান তাহলে সেই পরিবারের ওপরেও নাকি নেমে আসে চরম বিপর্যয়। এপুজো যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল সেই রামতারক গুপ্ত ছিলেন বিশ্বজিৎ সেনগুপ্তের পিতামহের পিতামহ। আসলে তাঁরা বদ্যি ব্রাহ্মণ।
তাঁদের ভিটের ১০০ মিটারের মধ্যেই মায়ের মন্দির। বিশ্বজিৎ সেনগুপ্তের কথায়, "পাঁচ প্রজন্ম আগে আমাদের বাড়ির এক মহিলা লালপাড় শাড়ি পড়ে, পায়ে নুপুর গলিয়ে আলতা পায়ে মায়ের মন্দিরে সন্ধ্যায় আরতি করতে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ তাঁকে ফিরতে না দেখে ওই মহিলার শ্বশুর মন্দিরে যান। সেখানে গিয়ে তাঁকে এক নির্মম ঘটনার সাক্ষী হতে হয়। তিনি গিয়ে দেখেন মায়ের মুখে রক্তমাখা শাড়ির পাড়। যে শাড়িটি পড়ে তাঁর পুত্রবধূ পুজো দিতে এসেছিলেন সেই শাড়ির লালপাড়ের টুকরো চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। পুত্রবধূকে নাকি আর কোনও দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর থেকেই ওই মন্দিরে মহিলাদের সন্ধ্যারতি দেওয়া নিষেধ হয়ে যায়। গুপ্ত পরিবারের মহিলাদের পায়ে নূপুর পরাও নিষেধ। এই মন্দিরে পুজোর সময় কোনও আলো লাগানো হয় না। এমনকী বাজে না কোনও মাইক্রোফোন বা লাউডস্পিকার। বাজনা বলতে শুধু ঢাকের বাদ্যি।"
আরও পড়ুন- কলকাতার কাছেই সেরার সেরা চোখ ধাঁধানো অফবিট ৫ সমুদ্র সৈকত! কোনটায় যাবেন?
ওই পরিবারের সদস্য বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত আরও বলেন, "আমাদের এই পুজোর কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। মায়ের মূর্তিতে ঠোঁটে রক্তমাখা শাড়ির পাড় আঁকা থাকে। এক আসনে পূজা। পঞ্চমুন্ডি আসনে পুজো।পূজারী রাতে সেই যে পূজা করতে বসবেন একেবারে পূজা শেষ করে ভোররাতে ঘটের সুতো কেটে বের হবেন মন্দির থেকে। তারপর পূজা শেষ। এরপর শুরু হবে বলি। এবারে ১৫ টির ওপর ছাগ বলি হবে বলে বিশ্বজিৎ বাবু জানান। এরপর ভোগ বিতরণ করে সন্ধ্যায় মূর্তি বিসর্জন হবে মায়েরই স্বপ্নাদেশ পাওয়া স্থানীয় এক জলাশয়ে। এরপর আবার কাঠামো নিয়ে যাওয়া হবে মন্দিরে। এইভাবেই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এই ঐতিহ্যবাহী কালীপুজো। যার মূর্তিগড়া থেকে পূজাপাঠ সবই প্রথম থেকে বংশপরম্পরায় হয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন- ভাইফোঁটা মিটলেই বিরাট বদল আবহাওয়ায়! আরও বাড়বে ঠান্ডা? নাকি নামবে বৃষ্টি?