একদিকে ভয়, অপরদিকে ভক্তি। এই দুইয়ের দোলাচলে শেষ পর্যন্ত ভক্তির মাধ্যমে ভয়কে জয় করার পন্থা অবলম্বন করে চলেছেন জঙ্গলমহল বাসী। দিনের পর দিন ফসল ঘরবাড়ি তছনছ করে চলেছে হাতির দল, তবুও প্রথা মেনে বছরের এই সময়টা বনদেবীর পাশাপাশি হাতি পুজো করেন ভক্তরা। রেওয়াজ চালু রয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই, কিন্তু ইদানিং পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে হাতির দাপাদাপি বেড়ে যাওয়ায় হাতিকে তুষ্ট করতে পূজার্চনাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে হাতি দেবতা স্বরূপ, হাতিকে তুষ্ট করলে হাতিও মানুষের ঘরবাড়ি অনিষ্ট করবে না।
গোটা মাঘ মাস জুড়ে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় বনদেবীর পুজোর প্রচলন রয়েছে, সেখানে মাটির তৈরি হাতি ঘোড়াও পুজো দিয়ে থাকেন স্থানীয়রা।
তাছাড়া বৈশাখ নয়, মাঘ মাসকেই বছরের প্রথম মাস হিসেবে পালন করেন আদিবাসী মূলনিবাসীরা, কারণ কৃষি নির্ভরশীল মূলনিবাসীরা মাসের প্রথম থেকেই নতুনভাবে কৃষিকার্য শুরু করেন। অনেকে একে কৃষি নববর্ষের সূচনাও বলে থাকেন। তিথি মেনে মাঘ মাসের বিভিন্ন দিন বিভিন্ন জায়গায় বনদেবীর পুজোর আয়োজন করেন জঙ্গলমহল বাসী। জমিতে লাঙ্গল দিয়ে দাগ কাটা হয়। জমির ফসল হাতি যাতে তছনছ না করতে পারে সেজন্য চলে হাতি পূজা।
আরও পড়ুন: বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই হাতির মৃত্যু পশ্চিম মেদিনীপুরে
মেদিনীপুর সদর ব্লকের এনায়েতপুর গ্রামে 'হাতি ধরা বুড়ি' মন্দিরে পূজা রচনা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকার মানুষের বক্তব্য, বহুবছর আগে এই গ্রামেই একটি হাতি মারা গিয়েছিল, শোকবিহ্বল গ্রামবাসীরা তারপর থেকে হাতি পুজো শুরু করেন। সেই পুজোকে ঘিরে তিনদিন ধরে চলে মেলা। মেদিনীপুর সদর ব্লকের লোহাটিক্রি গ্রামের জঙ্গলেও প্রথা মেনে বছরের এই সময়টা হাতি পুজো হয়। মাটির হাতি সংলগ্ন কাঁসাই নদী থেকে স্নান করিয়ে বাদ্যযন্ত্র সহকারে নিয়ে এসে গাছের তলায় রেখে পূজার্চনা হয়। নতুন চালের নবান্ন তৈরি করে ভোগ নিবেদন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা শেফালী সিং বলেন, "হাতি সাক্ষাৎ ভগবান, হাতিকে পূজার্চনা করলে সেও মানুষের ফসল ঘরবাড়ি নষ্ট করবে না, হাতি যাতে রেগে না যায় সেজন্যই আসছি।" ওই গ্রামেরই মধুসূদন রাউত যোগ করেন, "হাতি একদিকে বিশ্বকর্মার বাহন, অপরদিকে মা লক্ষ্মীরও বাহন, হাতি আরাধনার মধ্য দিয়ে লক্ষী বিশ্বকর্মাকেও আরাধনা করা হয়।"
হাতির পূজারী যদুনাথ চক্রবর্তী বললেন, "আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে পূজার্চনা করে আসছি, হাতিকে তুষ্ট করার জন্য বাসিন্দারা পূজার্চনা করেন, তবে আমার মনে হয় হাতি যখন লোকালয়ে চলে আসে, তখন মানুষ তাদের অযথা উত্ত্যক্ত করেন, তাদের গায়ে চকলেট বোম ছুড়ে মারেন, ইঁটপাটকেল ছুড়ে মারেন, এতে হাতির দল ক্ষেপে গিয়ে এলাকায় বেশি করে তছনছ করে, হাতির জন্য নির্দিষ্ট অভয়ারণ্য তৈরি করা প্রয়োজন।"
প্রসঙ্গত, বিগত দু-তিন মাস ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি, গড়বেতা, গোয়ালতোড়, গুড়গুড়িপাল, মনিদহ, গোপগড় প্রভৃতি এলাকায় ৭০-৮০ টি হাতির দল বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। সন্ধ্যা হলেই জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে বেরিয়ে ফসল ঘরবাড়ি তছনছ করছে। ফসল বাগরাম রক্ষা করার জন্য রাতের পর রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন গ্রামের যুবকরা।
এক কথায়, হাতির তাণ্ডবে নাস্তানাবুদ জঙ্গলমহল বাসী, তবুও প্রথা মেনে বছরের এই সময়টা তারা হাতি পুজো করে আসছেন, এ বছরও তার অন্যথা হয়নি। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগেই মেদিনীপুর সদর ব্লকের নেপুরা গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুটি হাতি মারা গিয়েছিল। দুটি হাতির মৃত্যুতে মন খারাপ হয়েছিল গ্রামবাসীদের। মৃত হাতির সামনে ধুপ জ্বালিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে প্রণামও করেছেন অনেকে।