"বসন্ত বাতাসে সইগো, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে" পূর্ব বর্ধমানের পাল্লারোড গ্রামের সঙ্গে গানটির অনেক মিল রয়েছে। শীতের শেষে বসন্ত বাতাসে রং যেন ছড়িয়েছে চারদিকে। আকাশের রং নীল। গাছের শাখায় কচি কচি নতুন পাতা। হাতে গোনা আর কয়েকদিন! তারপরেই সকলে মাতবে রঙের উৎসবে। বর্ধমানের একদল মহিলারা দোল উৎসবের প্রাক্কালে মেতে উঠেছেন রঙ তৈরির আনন্দে। !সাজ সাজ রব। সবাই হাতে হাত মিলিয়ে তৈরি করছে্ন নানা রঙের আবির। দোলের আগে প্রতি বছর রাসায়নিক দেওয়া রং বাজারে বিক্রি হয়, এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতেই এই ভেষজ রঙ তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য। ফুল, শাক পাতা, বিট, গাজর দিয়ে কীভাবে আবীর বানানো যায় সেই পদ্ধতি মহিলারা এবার ঘরেই বানিয়ে স্বনির্ভর হচ্ছেন।
সেই কোন সুদূর অতীত কাল থেকে দোলোতসব গোটা ভারতের প্রাচীন উৎসব। আধুনিক সময়ে এই প্রাচীন উৎসবে অনেকটায় ভাটা পড়েছে। অনেকের এখন রঙে ভয়। রাসায়নিক দিয়ে তৈরি রঙে, ত্বকে নানারকম অ্যালার্জি হওয়ার ভয়ে অনেকেই রং খেলা এড়িয়ে যান। কেউ কেউ আবার আবিরের রুক্ষ দানায় ত্বক ছড়ে যাওয়ার ভয় পান। আর সেসব থেকে মুক্তির উপায় এবার বাতলে দিচ্ছে কিছু গ্রাম্য মহিলা। তাদের উদ্যোগেই ভেষজ দ্রব্য থেকে তৈরি হচ্ছে হোলির রং। এসব রং তৈরি হচ্ছে বিট, গাজর, গাঁদাফুল কিংবা গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে। ভেষজ আবির। ত্বক খারাপ হওয়ার ভয় নেই এই আবিরে। চামড়া, চোখ বা শরীরে কোনও রকম ক্ষতির আশঙ্কাও থাকে না। বর্তমানে সকলে এই আবির তৈরি করার ব্যাপারেই জোর দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন- ধরাশায়ী তৃণমূল! বামেদের সঙ্গে নিয়েই সাগরদিঘিতে বিপুল জয় কংগ্রেসের
পূর্ব বর্ধমানের মেমারির পাল্লারোডের বাসিন্দা সঞ্চিতা পাল। এই গ্রামেরই গৃহবধু। গত বছর পল্লিমঙ্গল সমিতির সাহায্যে সঞ্চিতা মহিলাদের একটি দল তৈরি করেন। এই ৮-১০জনের দল নিয়েই শুরু করেছেন ভেষজ আবির তৈরির কাজ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে তৈরি নানা রঙের আবির বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে বাজারে। এর দামও যথেষ্ট পকেট ফ্রেন্ডলি। গত বছর যে পরিমাণ আবির তৈরি করা হয়েছিল সেই কাজ শেষ করার পরেও আবার নতুন অর্ডার এসেছে। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এই বছরেও অনেক আগে থেকে আবির তৈরির কাজ শুরু করেছেন। দোলের আর কয়েকদিন বাকি এর মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে সব।
'গাঁদার পাপড়ি কিংবা বিট সেদ্ধ করেই রং বের করা হয়। সেই রং মেশানো হয় এরারুটে। সামান্য পরিমাণ ফিটকারি আর সুগন্ধ আতর মিশিয়ে তৈরি হয় আবির। এতে কোন রকম কেমিক্যাল নেই। বাজারে আমরা প্রতি কেজি ১৭০টাকা করে বিক্রি করি' বলছিলেন সঞ্চিতা। সঞ্চিতারই এক সহকর্মী কাজ করতে করতে বলেন, 'গোলাপের পাপড়ির মিশ্রণে অদ্ভুত এক আভা আসছে আবিরে। এই আবির একদম মিহি, নেই কোনও দানা, খড়খড়ে জিনিস'। এদের সকলের কথায় এই আবির এক্কেবারে সুরক্ষিত উপাদানে তৈরি বলেই দাম একদম কম। আর এর চাহিদাও এখন অনেক বেশী। মহিলাদের দল তৈরির হওয়ায় পর আর্থিকভাবে অনেক উপকার হয়েছে।
দোল খেলা স্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা নিরাপদ সেই কথা বলতে গিয়ে চিকিৎসকরা বারবার পরামর্শ দিচ্ছেন ভেষজ আবির ব্যবহারে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এই মহিলাদের উদ্দ্যেশ্য রং খেলা হোক কিন্তু স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে। তার জন্যে তাঁরা জোর দিচ্ছে ভেষজ আবির তৈরিতে। জেলার পাশাপাশি কলকাতাতেও বেশ চাহিদা বাড়ছে এই আবিরের। শুধু দূষণ বা রাসায়নিকমুক্ত বসন্ত উৎসব-পালনই নয়, বরং এই ভেষজ আবির যেন পরিবেশে ভারসম্য বজায়ে নতুন করে রঙের প্রলেপ দিচ্ছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মুখেও বসন্ত হাসি ফোটাচ্ছে। ভেষজ আবির তৈরি করে সম্পূর্ণ ভাবে স্বনির্ভর হয়ে গ্রাম বাংলা মা বোনেরা।