Shahjahan Sheikh: তার নামে বাজার থেকে শুরু করে শ'য়ে শ'য়ে বিঘা মাছের ভেড়ি (fisheries) থেকে শুরু করে ইট ভাটা (brick kilns) এবং গেস্টহাউস (guesthouses)। তৃণমূল দাপুটে বাহুবলী নেতা শাহজাহান শেখের (Shahjahan Sheikh) সাম্রাজ্য সন্দেশখালির (Sandeshkhali) প্রায় প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকী তার প্রভাব দ্বীপাঞ্চলের বাইরেও বিস্তৃত রয়েছে।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED) এখন তার সম্পত্তি ধরে ধরে অভিযান চালাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ৬টি সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। তদন্তকারীদের জন্য একটি মূল চ্যালেঞ্জ হল তার এবং তার নির্দেশে দখল করা জমির মধ্যে সংযোগ খুঁজে পাওয়া।
এলাকায় 'ভাই' নামে পরিচিত, শেখ শাহজাহানের এমন প্রভাব ছিল যে সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী তৃণমূল (TMC) প্রার্থীরা প্রায়শই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা প্রতিপক্ষ প্রার্থীর সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধান রেখে জয়লাভ করতেন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দুটি ব্লক, সন্দেশখালি ১ এবং সন্দেশখালি ২ নিয়ে এই বিধানসভা কেন্দ্রটি গঠিত।
সন্দেশকালির পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে গত ৫ জানুয়ারি থেকে। ওই দিন ED-র একটি টিম শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল। সেই সময় শাহজাহান অনুগামীরা তাঁদের উপর চড়াও হয়। ফেব্রুয়ারিতে, সন্দেশখালি আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসে। দ্বীপাঞ্চলের মহিলারা শাহজাহান ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভুড়ি-ভুড়ি অভিযোগ নিয়ে রাস্তায় নামেন। তাঁরা কয়েক বছর ধরে শেখের অনুগামীদের দ্বারা যৌন হয়রানির (Sexual harassment) শিকার হয়েছিলেন। ৫৫ দিন পলাতক থাকার পর, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা শেখ শাহজাহান (Sheikh Shahjahan) গ্রেফতার হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস শাহজাহানের অনুগামী থেকে শুরু করে সন্দেশখালির স্থানীয় তৃণমূল নেতা এমনকী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গেও কথা বলেছিল। শাহজাহানের উল্কা গতির উত্থান ও এক মুহূর্তে এই পতন কাহিনী নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, শেখ শাহজাহান তার কর্মজীবন শুরু করেন সন্দেশখালিতে ট্রেকারদের সাহায্য করে। ধীরে ধীরে, তিনি বামফ্রন্টের সভা-সমাবেশে যেতে শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যেই সিপিআই(এম) (CPIM)-এর একজন প্রধানের কাছাকাছি পৌঁছে যান।
তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় ফিরলে দ্রুত শাহজাহানও সেই দলে ঢুকে পড়েন। স্থানীয় এক সিপিআই(এম) নেতার কথায়, “তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই রাজনীতি ও পেশীর জোরকে একসূত্রে বেঁধে ফেলেছিলেন। তৃণমূলে যোগদানের পর, তিনি এবং তার অনুগামীরা ধীরে ধীরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি ২০১৩ সালে সরবেরিয়া-আগারহাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হয়েছিলেন। তখন থেকে তাকে আর থামানো যায়নি।” তৃণমূলে ঢুকেই এলাকার বাকি নেতাদের দমিয়ে রেখে সন্দেশখালির অবিসংবাদিত 'ডন' হয়ে উঠেছিলেন শাহজাহান।
২০১৯ সালের ভোট-পরবর্তী সহিংসতায়, যখন স্থানীয় BJP নেতা প্রদীপ মণ্ডলকে (Pradip Mandal) খুন করা হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে পুলিশি অভিযোগে শেখ শাহজাহানের নাম ছিল। কিন্তু আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে তার নাম বাদ পড়ে যায়।
একইসঙ্গে তিনি তার সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করে চলেছিলেন। যারা তার জন্য কাজ করেছিল তারা এলাকার কৃষি জমি দখল করে মাছের ভেড়ি বানাচ্ছিল। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিংবা কখনও আবার গায়ের জোরেই চলছিল সেই কাজ।
আরও পড়ুন- Premium: বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগ, দ্বিধাবিভক্ত আইনজীবী মহল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েই প্রশ্ন
শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠদের মতে, ৪৩ বছর বয়সী এই যুবক প্রায় ২০০ জন যুবককে মাসে ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিত। সেই যুবকরা বাইকে করে সন্দেশখালিতে ঘোরাঘুরি করত। আসলে শেখ শাহজাহানের নিজেরও বাইক চালানোর শখ ছিল। তার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, “তিনি স্টান্ট করতেন, দাঁড়ানোর সময় রাইড করতেন। স্থানীয় যুবকরা এটি পছন্দ করেছিল। তার মোটরবাইকে এখন সন্দেশখালি দ্বীপের জেটির কাছে ধুলো পড়ছে।”
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সন্দেশখালির বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন মহিলা বলেছিলেন যে ভোটের দিনগুলিতে, শেখের "সেনাবাহিনী" কেবল বলতো যে কাকে ভোট দিতে হবে এবং তার দলবল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত থাকবে। কে কাকে ভোট দিচ্ছে তা দেখতে।
৮ মাস আগে সবচেয়ে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে, শেখ শাহজাহান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলেন। তৃণমূলের জেলা পরিষদের সদস্যও হয়েছিলেন। তাকে মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দল তাকে সন্দেশখালি বিধানসভা আসনের আহ্বায়ক এবং সন্দেশখালি-১-এর ব্লক সভাপতিও করেছে। উত্তম সর্দার (Uttam Sardar) এবং শিবপ্রসাদ হাজরার (Shibaprasad Hazra) মতো তৃণমূল প্রার্থী সেবার এলাকার মোট ভোটের ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ ঝুলিতে পুরে ফেলেছিল।
একজন প্রবীণ তৃণমূল নেতা বলেছেন, “নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর তার প্রভাবের কারণেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিরোধীদের কথা ভুলে যান, এমনকী তৃণমূলের মধ্যেও যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে হয় লাঞ্ছিত করা হয়েছিল বা দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
২০১৯ সালে, হলধর আরি, যিনি ২১ বছর ধরে বেড়মজুর এলাকার তৃণমূল সভাপতি ছিলেন, তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। শাহজাহানের ভাই সিরাজউদ্দিনকে (Sirajuddin) সেই জায়গায় বসানো হয়েছিল। হলধর আরি বলেছেন, “দ্রুত গতিতে উঠে ফের দ্রু গতিতেই রড়তে হল। শুধু দলকে এর জন্য মূল্য চোকাতে হল। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি। দলের নেতাদের ভালো, শিক্ষিত মানুষ হতে হবে যারা ভোটারদের জন্য কাজ করতে পারে। লুটপাট এবং বাহুবলী নয়, যারা ভয় দেখায় এবং জমি ছিনিয়ে নেয়।”
সম্প্রতি সিরাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে তৃণমূল আবারও হলধর আরিকেই এলাকার সহ-আহ্বায়ক করেছে। স্থানীয়দের মতে, শেখ শাহজাহান একটি সমান্তরাল ন্যায়বিচারের আদালতও চালাতেন। যেখানে দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য লোকেরা তার দিকেই তাকাবে, পুলিশ নয়। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “পুলিশের কোনও ভূমিকাই ছিল না। পুলিশ হয় অভিযোগ নিত না, কিংবা নিলেও টাকা চাইত। শেখ শাহজাহানের কথাই চলতো।"
আতঙ্ক ছড়িয়ে এলাকা শাসন করতো শাহজাহান। তবে শেখ শাহজাহান অনেককেই ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে কিংবা চিকিৎসা করানোর জন্য টাকা দিত। ধামাখালি বাজারের এক ব্যবসায়ী শেখ আজিজুল বলেন, "ভাইয়ের পকেটে সব সময়ই প্রচুর টাকা থাকত। যে কেউ সাহায্য চাইলেই তিনি তুলে দিতেন।"
যদিও শেখ শাহজাহান সিআইডির হাত ঘুরে এখন সিবিআই জিম্মায়। তবে এখনও বাসন্তী হাইওয়ে ধরে এগোলে বিস্তৃত ‘শেখ শাহজাহান মার্কেট’ চোখে পড়বে। বাজারে পার্ক করা, যেখানে তার মাছের পাইকারি ব্যবসা এবং একটি তিন তলা বিল্ডিংও রয়েছে। যা তারই মালিকানায় রয়েছে।