তাঁর বয়স হল পঁচাত্তর। তবু শরীরে জরা তেমন থাবা বসায় নি। এসে গেছে পরবর্তী প্রজন্ম। তবু আজও মহানগরের আকাশরেখার প্রধান মুখ বলতে রয়ে গেছেন তিনিই। কতবার গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র হয়ে এসেছেন গল্প-কবিতায়-ছবিতে-ফিল্মে। এখনও প্রতিদিন অজস্র মানুষের পরম নির্ভরতার স্মারক হয়ে আছেন। সম্প্রতি তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিনটি পালন করা হল বেশ জাঁকজমক সহকারে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরে গেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, আমাদের সেই চিরকালীন হাওড়া ব্রিজ! যার পোশাকি নাম রবীন্দ্র সেতু।
দুই যমজ শহর হাওড়া আর কলকাতার মধ্যে যোগাযোগের সেতু হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস খুব পুরোনো না হলেও খুবই আকর্ষণীয়। ১৮৬০ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে প্রান্তিক স্টেশন হিসেবে হাওড়া স্টেশন তৈরি করল তখন থেকেই একটা ব্রিজ ভীষণভাবে জরুরি হয়ে পড়ল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ও পণ্যসামগ্রী রেলপথে আসতে শুরু করল। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। সেখানে শুধু গঙ্গাবক্ষে স্টিমার, ফেরি আর দেশি নৌকায় নিয়মিতভাবে পণ্য সরবরাহ প্রায় অসম্ভব। একটা ব্রিজ চাই-ই চাই। আবার কলকাতা বন্দরও তখন খুব ব্যস্ত। নদীর জলে কোনোরকম স্থায়ী স্ট্রাকচার তৈরি যাতে না হয়, সেদিকে কলকাতা পোর্ট কমিশনারদের কড়া নজর। তাতে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে। ১৮৭১ সালে বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল পাশ করলেন ‘হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ (বেঙ্গল অ্যাক্ট IX, 1871)। সরকার আর ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলির এক চুক্তি হল, হাওড়া আর কলকাতার মধ্যে হুগলি নদীর ওপর তৈরি হবে একটি ভাসমান পন্টুন ব্রিজ। ভাইসরয় লর্ড মেয়ো ডিজাইন পছন্দ করলেন। ১৮৭৪ সালে তৈরি হল ব্রিজ। যার মাঝখানের অংশ বড় জাহাজ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যেত। ব্রিজটির বিভিন্ন অংশ ইংল্যান্ডে বানানো হয়েছিল, যেগুলো কলকাতায় নিয়ে এসে যথাস্থানে লাগানো হয়। যদিও অনেক ইঞ্জিনিয়ার এই ব্রিজের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ হুগলি নদী জোয়ারভাটা প্রবণ। ঝড়বৃষ্টি আর সাইক্লোনের দাপট সামলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই এ ব্রিজ কিন্তু দিব্যি টিকে গেল। যদিও বানানো হয়েছিল পঁচিশ বছর চালাবার জন্য, কিন্তু এটি তার প্রায় তিনগুণ বেশি সময় খুব সফলভাবে যান ও মানুষ পরিবহণ করল।
কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে যানবাহনের চাপ, মাল পরিবহণও কয়েক গুণ বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এই ভার বহনের জন্য ভাসমান পন্টুন ব্রিজ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় বোঝা যাচ্ছে। সংকীর্ণ ব্রিজ পার হয়ে কলকাতা থেকে হাওড়া যাওয়া ক্রমেই এক দুর্বিসহ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে লাগল যাত্রীদের কাছে। তাছাড়া যখন জাহাজ যায়, তখন ব্রিজ থাকে খোলা। জোয়ারের সময় নদীর জলতল বেড়ে ভাসমান অংশ এত খাড়া হয়ে যায় যে ঘোড়া বা গরুর গাড়ি প্রায় উঠতেই পারে না। ১৯০৯ সাল নাগাদ স্পষ্ট বোঝা গেল কলকাতা আর হাওড়ার বিশাল জনসংখ্যা আর ব্যবসাবাণিজ্যের প্রয়োজন পণ্টুন ব্রিজ আর মেটাতে পারবে না। চাই নতুন ব্রিজ।
আরও পড়ুন, ‘আর্মানি গির্জে’: কলকাতার প্রাচীনতম চার্চ
নতুন ব্রিজ বানানো নেহাত সোজা নয়। সরকার একের পর এক কমিটি বানিয়ে চলল যারা এই ব্রিজ কীভাবে বানানো যায় তার পর্যালোচনা করবে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯২১ সালে ছ জন সদস্য নিয়ে তৈরি মুখার্জী কমিটি। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট বরেণ্য বাঙালি শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জী। তাঁর কোম্পানি মার্টিন এন্ড কোং একের পর এক প্রাসাদ বানিয়ে বদলে দিয়েছিল কলকাতার চেহারা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও তাঁদেরই কীর্তি। রাজেন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সেরও প্রতিষ্ঠাতা। এই মুখার্জী কমিশন বহু সার্ভে ও সমীক্ষার পর যে রিপোর্ট জমা দিল তা হল হাওড়া আর কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ। একমাত্র এই ধরনের ব্রিজ থাকলে হুগলি নদীতে জাহাজের অবাধ চলাচল বজায় রাখা সম্ভব। কমিটি একই সঙ্গে জানাল পন্টুন ব্রিজের হাল এতটাই খারাপ যে এটির অবিলম্বে বদল প্রয়োজন।
১৯২৪ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে এই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হয়। ক্যান্টলিভার ব্রিজ বানাতে খরচের কথা ভেবে কাউন্সিলের সদস্যরা সহমত হতে পারছিলেন না। কেউ বলেছিলেন পন্টুন ব্রিজের বদলে জোড়া ব্রিজ বানানো হোক। খরচের প্রশ্নে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের মতামতও নেওয়া হয়। ১৯২৬ সালে পাশ হল হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট। শেষ অবধি ক্যান্টিলিভার ব্রিজের পক্ষেই রায় যায়। মেসার্স রেন্ডেল পামার ট্রিটন ১৯২৯ সালে ক্যান্টিলিভার ব্রিজের ডিজাইন ও ড্রয়িং জমা দেয়। ব্রিজ তৈরিতে মূল ঠিকাদার ছিল ডার্লিংটনের ক্লীভল্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি, আর সাব কনট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছিল তিন সুবিখ্যাত কোম্পানি – ব্রেথওয়েট, বার্ণ আর জেসপ। ১৯৩৬ সালে কাজ শুরু হয় এবং সাত বছর লাগে শেষ হতে। খরচ হয়েছিল ২৫০ লক্ষ টাকা।
আরও পড়ুন, ময়নাগড়ের ময়নামতী
এখন যে হাওড়া ব্রিজকে আমরা দেখি, তা হল সাসপেন্ডেড ব্যালেন্সড ক্যান্টিলিভার স্টিল ট্রাস ব্রিজ। অধীকাংশ স্টীল সরবরাহ করেছিল জামশেদপুরের টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। প্রায় ২৬৫০০ টন স্টীল লেগেছিল ব্রিজ বানাতে। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় হাওড়া ব্রিজ, কারণ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কেবল এক একলা ট্রাম ধীর গতিতে ব্রিজ পেরিয়ে এর শুভ সূচনা করে। আর আজ, সেই ট্রামেরই প্রবেশ নিষিদ্ধ হাওড়া ব্রিজে। ব্রিজ চালু হওয়ার পর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের ভার ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টের ওপর ন্যস্ত। এই ব্রিজের ট্রাসগুলি সম্পূর্ণ লো অ্যালয় হাই টেনসাইল স্টিল রিভেটেড। দেশে তখন ষ্টিল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির বিকাশের সময়, তাদের পক্ষে এই নির্মাণ হয়ে ওঠে গর্বের প্রতীক।
৭৫ বছর ধরে কলকাতার প্রবেশদ্বার হাওড়া ব্রিজ প্রতিদিন পার করে এক লক্ষ গাড়ি আর দেড় লক্ষ পথচারীকে। অথচ প্রথমদিকে মানুষ, পশুচালিত গাড়ি, গুটি কয়েক মোটর আর মিলিটারি ট্রাক চলত এর ওপর দিয়ে। এই ব্রিজকে ব্যবহারিক ঐতিহ্য (Functional heritage) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। স্টীল এখন এক মহামূল্যবান উপকরণ, ব্রিজ বানাতে এর ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। স্ট্রাকচারাল, মেটালার্জিকাল ও সিভিল তিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মিলিত প্রয়াস বলা যেতে পারে একে, আবার এটি ইন্দো-ব্রিটিশ যৌথ উদ্যোগের স্মারকও বটে। ১৯৬৫ সালের ১৪ জানুয়ারি হাওড়া ব্রিজের নামকরণ হয় রবীন্দ্রসেতু।
বাঙালির আর্থ-সামাজিক জীবনে রবীন্দ্রসেতু বা হাওড়া ব্রিজের গুরুত্ব অপরিসীম। বড়বাজার, পোস্তা অঞ্চলের বাণিজ্য, ডালহৌসির অফিসপাড়ার ব্যস্ততা সবকিছুরই জীবনরেখা এই ব্রিজ। সারা বিশ্বে দৈর্ঘের বিচারে এটি ষষ্ঠ ক্যান্টিলিভার ব্রিজ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সে আসে ‘হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে/হ্যারিসন রোড চলে তার পিছেপিছে’ আবার অশোক কুমার-মধুবালা-হেলেন অভিনীত ছবির নাম হয় ‘হাওড়া ব্রিজ’। লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ বা আমেরিকার ব্রুকলিন ব্রিজের মতোই এ শহরের প্রতীক হয়ে সে রয়ে গেছে পঁচাত্তর বছর। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ৯৭৮টি গ্যাস বেলুন স্কোয়াড্রন জাপানী বোমার হাত থেকে রক্ষা করেছিল একে। ২০০৫ সালের ২৪ জুন একটি জাহাজ ব্রিজের নিচে আটকে গিয়ে ক্ষতি করেছিল যা দ্রুত সারানো হয়। বর্তমানে ব্রিজের স্টিলের সবচেয়ে বড় সমস্যা পাখি, বাদুড়ের বর্জ্য, ফুলবাজারের আবর্জনা এবং মানুষের থুতু ও পানের পিক। স্টিল পিলার গুলিকে ফাইবার গ্লাস দিয়ে ঘিরে, নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রেখে এর আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা চলছে অবিরাম। ব্রিজ রঙ করতে ২৬০০০ লিটার সীসামুক্ত রঙ লাগে।
আরও পড়ুন, এ এক অন্য লাল বাড়ির গল্প
পঁচাত্তর বছর ধরে একই রকম রয়ে গেছে সে। তার বুক থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বহু মানুষ জীবন শেষ করায় সম্প্রতি কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছে। মাঝেমাঝেই কোনো ভবঘুরে মানসিক প্রতিবন্ধী ব্রিজের ট্রাস বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে। এসে গেছে দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা বিদ্যাসাগর সেতু। তবু জনবহুল হাওড়া ব্রিজের গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি।