রামেশ্বর হাঁসদা। বয়স ৫৫। স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে সংসার। নিবাস বাঁকুড়ার সোনামুখী থানার ভুলা গ্রাম। ঠাঠাপোড়া দুপুরে রামেশ্বরবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল হাতি তাড়ানোর জন্য হুলা জড়ো করা রয়েছে বাড়ির উঠোনে। রয়েছে হুলায় আগুন ধরানোর জন্য পোড়া মোবিল। ২২ জনের হুলা পার্টি রয়েছে এই গ্রামে। তার দলপতি রামেশ্বর। একরাশ হতাশা তাঁর গলায়। পড়াশুনা করেও ছেলেদের কোনও চাকরি হয়নি। তাঁর ভোট নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। রামেশ্বরের আক্ষেপ ও ক্ষোভের কথা জানালেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে।
Advertisment
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে হুলা পার্টিতে কাজ করে আসছেন রামেশ্বর হাঁসদা। শুধু বাঁকুড়া নয়, হাতি তাড়াতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাক পড়ে রামেশ্বরের। মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার কাজ করে চলেছেন অনবরত। তবে নিজেদের জীবনযাত্রার মানোয়ন্নয়ন ঘটেনি, জানালেন রামেশ্বর। আগামী বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই তাঁর। তবে তাঁর গলায় আক্ষেপের সুর। তিনি বলেন, "ছোট ছেলে সুরেন্দ্রনাথ আট কিলোমিটার দূরে পাথরমোড়া হাইস্কলে পড়ছে। উচ্চমাধ্যমি দেবে। বড় ছেড়ে রাজীব সোনামুখী কলেজে পড়াশুনা করেছে। তবে গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তখন আমার দুর্ঘটনার ঘটেছিল। হাতি আছড়ে দিয়েছিল। মেজ ছেলের সঞ্জয়ের পড়াশুনা মাধ্যমিক পর্যন্ত।"
এক-দেড় বিঘে জমি আর হুলা পার্টির কাজ। এই নিয়েই সংসাহ টেনে চলেছেন রামেশ্বরবাবু। তিনি বলেন, "হাতি তাড়ানোর কাজ থাকলে দিনে ২৭০ টাকা মজুরি জোটে। অন্যত্র বাইরে গেলে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দৈনিক মজুরি মেলে। বছরে ৫০-৬০দিনও এই কাজ হয় না। ছেলেরা কোনও চাকরি পায়নি। বেকার ঘুরে বেরাচ্ছে। সিভিক পুলিশ, বনসহায়ক পদে লোক নিয়েছে। আদিবাসীদের একজনও চাকরি পায়নি।"
Advertisment
এক্সপ্রেস ফোটো- পার্থ পাল
জঙ্গলমহলে হাতি আতঙ্কের সঙ্গেই হুলা পার্টির সদস্যরাও অবহেলার শিকার দীর্ঘ বছর ধরে। বাবা বিশ্বকর্মা হুলাপার্টির নেতা রামেশ্বর বলেন, "উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হাতি তাড়াতে গিয়েছি। এই কাজ করে আসছি দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে। বনদফতরের লোকেরা পথ দেখিয়ে দেয় সেই রাস্তা দিয়ে হাতি তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়। এখন আর পটকা ফাটানো হয় না। হুলা দেখতে দেখতে হাতির দলও অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। হয়ত একদিন এই হুলাকেও ভয় পাবে না।"
হাতি তাড়াতে গিয়ে কখনও বিপদে পড়েননি? "জীবনে দুবার মৃত্যুর মুখে থেকে ফিরে এসেছি," বলেন রামেশ্বর। বা পায়ের নীচের অংশ দেখিয়ে রামেশ্বর বলেন, "মাস্টারডাঙ্গার জঙ্গলে শুঁড়ে তুলে হাতি আছাড় দিয়েছিল। তখন পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। তারপর বাড়ির কাছে ধান জমিতে আবার শুঁড়ে তুলে আছড়ে ছিল। দ্বিতীয়বার প্রায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসা চলেছে। একসময় আমাদের জীবনবিমা করে দিয়েছিল বনদফতর। ৬-৭ বছর ধরে সেই বিমাও নেই। পরিবারের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।"
রামেশ্বর হাঁসদার ভাইপো বাপি হাঁসদাও ছোট থেকেই হুলা পার্টির সঙ্গে যুক্ত। ৩৩ বছরের বাপি বলেন, "১৫ বছর ধরে হাতি তাড়ানোর কাজ করছি। আমরা জঙ্গলে থাকা মানুষ। অথচ বনসহায়কের পদে নিয়োগ করা হয়েছে শহরের লোকজনকে। এটা আমাদের বড় আক্ষেপ।" নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বনদফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, হুলাপার্টির সদস্যদের বিমার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রশাসনিক স্তরে আলোচনা হবে। তবে বনসহায়ক পদের চাকরি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ওই আধিকারিক।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
আমাদের নিউজলেটার সদস্যতা!
একচেটিয়া অফার এবং সর্বশেষ খবর পেতে প্রথম হন