বই কিনে পড়া সে অঞ্চলে বিলাসিতা। ক্ষুধা আপোস করে না। তাই লেখাপড়া শব্দটি সেখানে কমই উচ্চারিত হয়। ছোট থেকে বাবা মা কানে মন্ত্র দিতে থাকেন, একটু বড় হয়েই লেগে পড়তে হবে মিস্ত্রি বা শ্রমিকের কাজে। ফলে, লেখাপড়া হয় না বললেই চলে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না! ওদের লেখাপড়া করাতেই হবে, বোঝাতে হবে লেখাপড়ার গুরুত্ব- এমন দৃঢ় ভাবনা নিয়েই দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন আইআইটির গবেষক দম্পতি অনির্বাণ নন্দী ও পৌলোমী চাকি নন্দী।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তাঁরা জানান, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও পাহাড়ি অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা। অনির্বাণ বলেন, "পোশাক ময়লা, পেটে খিদে, পুঁজি বলতে তেমন কিছু নেই। ভগ্নপ্রায় মাটির ঘর বাড়ি। অথচ হাতে স্মার্টফোন। লেখাপড়া কতদূর জিজ্ঞাসা করলে একে ওপরের দিকে চায়। তখনই বুঝতে পারি লেখাপড়ার দৌড় বেশি দূর নয়। গবেষণার কাজের জন্য আমি আর আমার স্ত্রী ঘুরে বেড়াই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। একই ছবি দেখতে পাই সেখানকার বেশ কিছু অঞ্চলে। তখনই মনস্থির করি, ওই সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের লেখাপড়ার দিকে ঝোঁক বাড়াতে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী?"
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/library-2.jpg)
অনির্বাণবাবু বলেন,"টেকনিকাল নয়, সামাজিক সমস্যায় ভরপুর উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম। টাকা পয়সার জোর না থাকায় তাদের সামাজিক পরিকাঠামোও নেই। এর ফলে গোটা জগতে যে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে ওঁরা পিছিয়ে যাচ্ছে। সামান্য কিছু উপহার দিয়ে চ্যারিটি করে কাউকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তখনই নিজের যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে বই জোগাড় করতে শুরু করি। সেভাবে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না আমাদের। আমরা শুধু বই সংগ্রহ করে যেতাম। কেন করছি, কী করছি সেসব লাভ ক্ষতির অঙ্ক তখনও কষিনি। অনেক বই সংগ্রহ করার পর নবম শ্রেণীর ব্যকারণ বই চারটে, অষ্টম শ্রেণীর পাঁচটা ভূগোল বই নিয়ে একটা তালিকা করি। এরপরই, আমরা লাইব্রেরী তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। গাড়িতে করে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে সেই বই নিয়ে যাই। সেখানকার ছেলে মেয়েরা বই সংগ্রহ করে আমাদের থেকে এবং পড়ে সময় মতো আবার ফেরতও দিয়ে দেয়"।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/IMG_5836.jpg)
"যে এলাকায় যাব ঠিক করি, প্রথমে সেখানকার স্বনির্ভর সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করি। কারণ, তাদের মারফত খবর ছড়ানোটা সহজ হয়। ছেলেমেয়েরাও জেনে যায় যে আমরা আসছি এবং তাঁরা পড়ার জন্য বই পাবে। প্রায় চার ঘণ্টা এক এক জায়গায় ওই গাড়ি (ভ্রাম্যমান পাঠাগার) নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। কারণ, অনেকেই পড়তে সময় নেয়। পাশাপাশি, আমরা স্যানিটারি সচেতনতার প্রচারও করি। ওই সমস্ত গ্রামে মহিলাদের হাতে বিনামূল্যে প্যাড তুলে দিই আমরা। এরপর প্রতি মাসে তাঁরা যাতে প্যাড পায় সে ব্যবস্থাও করে দিই"।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/IMG_5840.jpg)
কিন্তু, এত কিছু কী নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করেই হয় নাকি ডোনেশন ব্যবস্থা রেখেছেন? উত্তরে অনির্বাণ জানান, "আমরা একটা ওয়েবসাইট বানিয়েছি। সেখানে একটি ফর্ম আছে। সেখানে কে কটি প্যাড দিতে চায় এবং নিজেদের এলাকা নথিভুক্ত করতে পারেন। সেই তথ্য অনুযায়ী যথাস্থানে গিয়ে আমরা প্যাড সংগ্রহ করি। একইভাবে বইও সংগ্রহ করি আমরা। তবে নিজের গাঁটের কড়ি থাকেই। ওই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পেরে আমরা স্বামী-স্ত্রী খুবই খুশি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেহুতু মোবাইলের চল আছে, তাই তাঁদের কাছে গিয়েও আমরা আমাদের ওয়েবসাইট সম্পর্কে পরিচিতি করছি। যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তাঁরা বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নিতে চায়। সে ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট মারফৎ জানিয়ে দেয় পড়ুয়ারা। সম্প্রতি ডিজিটাল ক্যাটালগ বানানোর কথাও ভাবতে শুরু করেছি"।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/IMG_5838.jpg)
অনির্বাণ বলেন,"গ্রামের মানুষের মধ্যে আগ্রহ অনেক। তাঁরা জানেন, তাঁদের ঠিক কী প্রয়োজন। অনেক ছেলেমেয়ে এবং গৃহবধূ আছেন, যাঁরা আমাদের গাড়ি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই পড়াশোনা করেন। অসুবিধা হলে জিজ্ঞাসা করেন আমাদের"।