FIR Against TMC Leader: নদ-নদী থেকে বালি চুরি হওয়া নিয়ে রুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী। এনিয়ে প্রতিটি প্রশাসনিক সভাতেও তিনি স্বোচ্চার হয়ে থাকেন। সেটা জেনেও দামোদরের বুকে অবৈধ খাদান খুলে দিব্যি বালি লুট চালিয়ে যাচ্ছিলেন তৃণমূল নেতা শেখ সাহাবুদ্দিন ওরফে দানি। তবে এমন স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে এখন বড় বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের এই তৃণমূল নেতা। নিজেকে রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের ঘনিষ্ট বলে জাহির করেও প্রশাসনের 'কলমের খোঁচা' থেকে তিনি রেয়াত পাননি। ভূমি দফতরের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তৃণমূল নেতা 'দানির' বিরুদ্ধে কড়া আইনি ধারায় মামলা রুজু করেছে। লোকসভা ভোটের মুখে এই মামলার বিষয়টি জানাজানি হতেই কার্যত হুলস্থূল পড়ে গিয়েছে। আর তা আঁচ করে বিজেপি নেতারাও বলতে শুরু করেছেন, 'মুখ্যমন্ত্রীর দলের নেতারাই যে আসল বালি লুটেরা সেটা এবার প্রমাণ হয়ে গেল।'
তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শেখ সাহাবুদ্দিন ওরফে দানি জেলার জামালপুর ব্লকের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত চক্ষণজাদি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি শুধুমাত্র তৃণমূলের বেরুগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি-ই নন, তিনি বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতেরও সদস্যও। পঞ্চায়েতের পূর্ত-সঞ্চালক পদ-ও তিনি-ই অলঙ্কৃত করেন। নিজেকে প্রভাবশালী প্রমাণ করতে রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে সাক্ষাতের নানা সময়ের ছবিও দানি সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে রেখেছেন। এহেন এক নেতার বিরুদ্ধে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর এফআইআর দায়ের করার পর থেকে কার্যত সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করছে বালি লুটেরারা।
শক্তিগড় থানায় দায়ের করা এফআইআরে বর্ধমান ২ ব্লকের বিএলআরও সৌরভ রক্ষিত জানিয়েছেন, 'দামোদরে অবৈধ খাদান খুলে বালি লুট' চলছিল। সেই খবর তাদের কাছে আসে। এরপরেই তারা বেরুগ্রাম অঞ্চলের শম্ভুপুর মৌজার বর্ডার সংলগ্ন বর্ধমান ২ ব্লকের গোপালপুর মৌজায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি হওয়া ওই অভিযানে জেলা, মহকুমা(বর্ধমান উত্তর) ও ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অফিসাররা ছাড়াও পুলিশ এবং ক্ষুদ্র-খনিজ বিভাগের বিভাগীয় অফিসাররাও সামিল ছিলেন। বাধা পেরিয়ে তারা সবাই অভিযান স্থলে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে তাঁরা অবৈধ খাদান চালু করা এবং খননকার্য চলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পান। এসবের মধ্যেই পালিয়ে যায় খনন কাজে যুক্ত লোকজন। তবে বালি নেওয়ার জন্যে তখনও ওই অবৈধ খাদানে চারটে ডাম্পার দাঁড়িয়ে ছিল।
ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের আধিকারিকের করা এফআইআর অনুযায়ী, বালি মাফিয়ারা ওই চারটে ডাম্পার বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি এক ডাম্পার চালককে পাকড়াও করেন। জেরায় ওই ডাম্পার চালক ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের আধিকারিকদের জানায়, গোপালপুর মৌজায় অবৈধ খাদানটি চক্ষণজাদি গ্রামনিবাসী শেখ সাহাবুদ্দিন ওরফে দানি চালান। চালকের এই বয়ানকেই হাতিয়ার করে বর্ধমান ২ ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিক। তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি দানির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ও খনিজ আইনের একাধিক ধারায় এফআইআর রুজু করেন। এই বিষয়টি এতদিন অপ্রকাশ্য রয়েগেলেও কয়েক দিন আগে তা প্রকাশ্যে আসে, তারপরই হুলস্থুল পড়ে যায়। যদিও এফআইআর রুজু হলেও সেটা মিথ্যা অভিযোগ বলে দাবি করেন তৃণমূলের নেতা দানি, ঘুরে বেড়াচ্ছেন ডোন্ট কেয়ার মনোভাব দেখিয়েই। এই প্রসঙ্গে বিএলআরও সৌরভ রক্ষিত বলেন, 'আমি এফআইআর দায়ের করে দিয়েছি। এরপর যা পদক্ষেপ করারর সেটা পুলিশ করবে।' তবে তদন্তের খাতিয়ে শক্তিগড় থানার পুলিশ এ ব্যাপারে কিছু বলতে নারাজ।
আরও পড়ুন- Abhishek Banerjee: এবার পাল্টা চ্যালেঞ্জ অভিষেকের! সন্দেশখালি নিয়ে কৌশল বদলালো তৃণমূল?
এদিকে দানির বালি লুটের কীর্তি ফাঁস হওয়ার পর মুখ খুলেছেন বেরুগ্রাম অঞ্চলের অনেক বাসিন্দা। তাঁরা বলছেন, 'দানির বালি লুটের সাম্রাজ্য চালানোর কথা শাসক দলের নেতারা সবই জানতেন। শাসক দলেরই একাংশ জনপ্রতিনিধি বিষয়েটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রশাসনের নানা মহলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তখনই যদি দল দানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত,তাহলে আজ এভাবে দলের মুখ পুড়ত না।' তবে এখন গ্রামবাসীদের এই বক্তব্যকেই যেন শিরোধার্য গণ্য করে নিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। সেই মত জামালপুরের তৃণমূল বিধায়ক অলক মাঝি সাফ বলছেন, 'দল ও সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কেউ অবৈধ বালি কারবারে যুক্ত থাকলে, তাঁর শাস্তি পেতেই হবে। তিনি দলের নেতা হলেও রেয়াত পাবে না।'
তৃণমূল বিধায়কের এই বক্তব্যকে অবশ্য কোনও গুরুত্ব দিতে চায়নি বিজেপি নেতারা। উল্টে তারা বালি লুট নিয়ে আরও বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছেন। জামালপুর নিবাসী বিজেপির জেলা নেতা জীতেন্দ্রনাথ ডকাল সরকারি নথি দেখিয়ে দাবি করেন, 'এবছর পূর্ব বর্ধমান জেলায় ৪০টি খাদানের লিজ অনুমোদন করেছে সরকার। তার মধ্যে জামালপুর ব্লকে দামোদরের ১৩টি ঘাট থেকে বালি তোলার লিজ অনুমোদন করা হয়েছে। লিজ দেওয়া ওই ১৩টি খাদানের মধ্যে ৯টি রয়েছে বেরুগ্রাম অঞ্চলে। সেই ৯টি খাদানের মধ্যে ৬ টির লিজ দেওয়া হয়েছে বেরুগ্রামের জামুদহ মৌজায়। বাকি ৩টি খাদানের ১টি চক্ষণজাদি, ১টি চলবলপুর এবং ১টি হৈবতপুর মৌজায় অবস্থিত। এগুলির বাইরে আঝাপুর অঞ্চলের সাঁচরা মৌজায় ২টি, জ্যৌৎশ্রীরাম অঞ্চলের মুইদিপুর মৌজায় ১টি, পাঁচরা অঞ্চলের হাবাসপুর মৌজায় ১টি খাদানের লিজ দেওয়া হয়েছে।'
সরকারি ভাবে দেওয়া লিজের তথ্যের সূত্র ধরেই জীতেন্দ্রনাথবাবু বলেন, 'জামালপুর ব্লকে ১৩টি বৈধ খাদানের একটিরও লিজ হোল্ডার দানি বা অন্য কোন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা নন। তবুও জামালপুর ব্লকে ১৩ টি খাদানের বাইরে আরো বেশি সংখ্যায় খাদান চলছে। তার মধ্যে ৪ টি অবৈধ খাদান রমরমিয়ে চলছে জামালপুর ১ এবং ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। ওইসব অবৈধ খাদানের দু'টি চলছে জামালপুরের জোড়বাঁধ ও তার সংলগ্ন নতুনগ্রামের কাঁঠালতলা এলাকায়। আর অপর দু'টি চলছে জামালপুরের পুলমাথা তেলকুপি ঘাট ও তার সংলগ্ন জায়গায়। অথচ এই দুই পঞ্চায়েত এলাকতেই রয়েছে ব্লকের সমস্ত স্তরের প্রশাসনিক দফতর এবং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্য কার্যালয়। একইরকম অবস্থা বেরুগ্রাম,পাঁচরা ও জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলে।' জীতেন্দ্রনাথের দাবি করেন, 'প্রশাসন নিরপেক্ষ তদন্ত করলে এইসব অবৈধ খাদান চালুর সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের যোগ সাজসের প্রমাণ মিলে যাবে।'
তৃণমূল নেতাদানির বিরুদ্ধে বিএলআরও-র এফআইআর-এর পর মঙ্গলকোটের মাজিগ্রাম অঞ্চলের কোয়ারপুর ও মালিয়ারা মৌজায় অজয় নদ থেকে অবাধে বালি লুটের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা জেলা ও ব্লক প্রশাসনের নানা মহলে অভিযোগ জানিয়েছে।