বদলে যাচ্ছে নদীর অভিমুখ, নদী সংলগ্ন গ্রামগুলিতে ধ্বস নামার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, নদীর অভ্যন্তরে তৈরি হচ্ছে বড় বড় খাদ। এসব কিছু ঘটে চলেছে অবৈধভাবে বালি তোলার জন্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের কাঁসাই-শিলাবতী নদীর এ ঘটনা সাম্প্রতিক নয়, বেশ পুরনোই বলা চলে। এ নিয়ে গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ দেখালে বা আন্দোলন গড়ে তুললে বিষয়টা একটু থিতিয়ে যায়- এই যা। কয়েকদিন পর ফের যে কে সেই। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, বালি তোলার মুনাফার অংশ পৌঁছে যায় স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পুলিশ- সকলের কাছেই।
কেন এই অবৈধ বালি উত্তোলন? কারণ বৈধ ভাবে বালি তোলায় ব্যবসায়ীদের মুনাফা তত থাকে না। গোটা ব্যাপারটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
খাদান সংলগ্ন গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বালি খাদান পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয় বালি ব্যবসায়ীদের। ১৫ বিঘা বালি এলাকা লিজের জন্য ন্যূনতম সরকারি রেট ১২ লক্ষ টাকা। তবে এ অঙ্কে আদৌ আটকে থাকে না লিজের মূল্য। নিলামে চড়তে চড়তে তা কোটির ঘর ছুঁয়ে ফেলে। লিজের সময়সীমা পাঁচ বছরের। যিনি লিজ নেবেন, তিনি ওই ১৫ বিঘা এলাকা থেকে বালি তুলে বিক্রি করতে পারবেন। এ হল বৈধ খাদান। কিন্তু এতে মুনাফা তত নেই, যত আছে অবৈধ খাদানে। মনে রাখতে হবে, মুনাফার টাকার অংশ পৌঁছে দিতে হয় নেতা থেকে আইনরক্ষক অবধি সকলের কাছে।
এবার আসা যাক অবৈধতার অংশে। গ্রামবাসীরা বলছেন, যিনি পাঁচ বছরের জন্য ১৫ বিঘা বালি এলাকা লিজ পান তিনি ১৫ বিঘার জায়গায় ৩০-৪০ বিঘা বালি এলাকা থেকে বালি তোলেন। প্রশাসন কিংবা স্থানীয় নেতারা নীরব কারণ যথাস্থানে পৌঁছে যাচ্ছে বাড়তি মুনাফার অংশ। নিয়ম রয়েছে, বালি খাদান থেকে বালি তোলার জন্য শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু বাড়তি মুনাফার জন্য নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেশিন দিয়ে বালি তোলা হচ্ছে- এ ব্যাপারেও স্পিকটি নট সক্কলে। হিসেব কষে দেখা গিয়েছে, একটি ছয় চাকার লরিতে বালি ভর্তি করতে কুড়ি জন শ্রমিকের দেড় ঘন্টা সময় লাগে, এবং তাতে খরচ আড়াই হাজার টাকা। ওই লরিতে মেশিন দিয়ে বালি ভর্তি করতে খরচ হয় দেড় হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি মুনাফার জন্য বালি ব্যবসায়ীরা মেশিনই ব্যবহার করে থাকেন বেশিরভাগ সময়ে।
বালি ব্যবসার ক্ষেত্রে আরেকটি খুব পরিচিত বিষয় 'পুলিশি টোকেন'। লরি পিছু পুলিশকে টাকা দিতে হয় এই টোকেনের মাধ্যমে। পুলিশের লোকজন খাদানে গিয়ে লরি চালকদের কাছ থেকে টোকেনের বিনিময় টাকা সংগ্রহ করে বলে অভিযোগ। এই টোকেন এর দরুন ৩০০ -৬০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়ে থাকে। লরিতে বালি ওভারলোডের পরিমাণের ওপর টাকার পরিমাণ ধার্য হয়। বালিভরা লরি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে এই টোকেন দেখালেই পুলিশি হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে কোথাও কোথাও টোকেন দেখালেও বাড়তি টাকা দিতে হয় ভ্রাম্যমাণ পুলিশদেরকে। লরি চালক রহমত সরদার বললেন, "টাকা দিয়ে টোকেন নিলেও মাঝেমধ্যে পুলিশি হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়,বালি লরি অন্য থানা এলাকা থেকে নিয়ে গেলেও সেখানে বাড়তি টাকা গুনতে হয়।" যদিও জেলা পুলিশের এক কর্তা টোকেনের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "প্রত্যেক বালির লরিতে সিও (চালান অর্ডার ) রয়েছে কিনা সেটাই রাস্তায় দেখা হয়, টোকেন দিয়ে টাকা তোলার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।"
কংসাবতী নদী সংলগ্ন নেপুরা গ্রামের বিনু সিংয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, "গ্রামবাসীদের বারংবার অভিযোগ সত্ত্বেও বালি ব্যবসায়ীরা মেশিন দিয়েই বালি তোলেন, তবে মাঝেমধ্যে প্রশাসনের তরফে বালি খাদানে অভিযান হয়, মেশিন বাজেয়াপ্তও করা হয়। দু এক দিন বন্ধ থাকার পর ফের মেশিন দিয়েই বালি তোলার কাজ শুরু হয়ে যায়।" কঙ্কাবতী গ্রামের জীবন মেট্যা বললেন, "সকলেই সবকিছু জানে, টাকার ভাগ সর্বত্র পৌঁছয় তাই সকলে চুপ থাকে।" মনিদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ প্রধান অঞ্জন বেরা অবশ্য বালির এই অবৈধ কারবারের কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি বললেন, "এ কথা সত্যি যে বালি ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট লিজ এরিয়া ছাড়াও বাড়তি এলাকা থেকে বালি তুলছেন। কোথাও কোথাও মেশিন দিয়েও বালি তোলা হচ্ছে,আমরা পঞ্চায়েতের তরফ থেকে নিয়মিত নজর রাখি এবং পদক্ষেপও নিই। বালির এই অবৈধ কারবার আগের থেকে অনেকটাই কমেছে তবে সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নি।"
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রশাসনিক সভায় যোগ দিয়ে অবৈধ বালি নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অফিসারদের। মুখ্যমন্ত্রীর এই হুঁশিয়ারির পরে যথেষ্ট নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন, প্রশাসনিক কর্তারা দফায় দফায় বিভিন্ন বালি খাদানে অভিযান চালিয়েছে, বালি তোলার মেশিনও বাজেয়াপ্ত করেছে। মনিদহ গ্রামের বাসুদেব খিলার অবশ্য তাতে খুব আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, "এরকম অভিযান বহুবার হয়েছে তার কয়েকদিন পরেই আবার যেই কি সেই অবস্থাই হয়েছে।"