Advertisment

রাষ্ট্রহীনতা ঘুচেছে ৬৮ বছরে, তবুও মনে বিরাট বড় 'কিন্তু'

এদেশ এখনও ছিটমহলের অধিবাসীদের আপন করতে পারেনি। ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তাঁদের আফসোসের অন্ত নেই। অনেকেই ভাবছেন, আগেই ভাল ছিলাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Chitmahal Coochbehar Express Photo Shashi Ghosh

ছিটমহলের বাসিন্দারা নাগরিকত্বের পরিচয় পেয়েছেন, তবে জমি-ঘর থাকতেও পাননি সেই সবের কোনও অধিকার। ছবি- শশী ঘোষ

ওঁরা ছিটমহলের অধিবাসী। এতদিন ছিলেন দুটি দেশের মধ্যবর্তী হয়েই। পরবর্তীকালে আধার, র‍্যাশন বা প্যান কার্ডসহ যাবতীয় পরিচয়পত্র নির্ঝঞ্ঝাটে পেলেও এখনও মনেপ্রাণে ভারতীয় হতে পারেননি। আবার কোনোদিন বাংলাদেশের নাগরিকত্বও পাননি। কারণ কোনও ভৌগোলিক বা আত্মিক যোগাযোগ ছিল না বাংলাদেশের সঙ্গে। ছিল না অন্য কোনো ছিটমহলের সঙ্গে সংযোগ। কিন্তু ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েও রয়ে গেছে আফসোস। 'নেই দেশের' বাসিন্দা যখন ছিলেন, তখনই বেশ সুখ-শান্তিতে ছিলেন। তাঁদের আত্মোপলব্ধি, "যখন কোনও দেশ ছিল না, তখনই বেশি ভাল ছিলাম। এত ঝঞ্ঝাট ছিল না।"

Advertisment

আরো পড়ুন: তিনবিঘা করিডোরে ব্রাত্য ভারতীয়রাই?

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল সমস্যা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, চাবাগানের মালিকসহ প্রভাবশালীদের জন্যই ছিটমহলের সৃষ্টি হয়। সীমানা নির্ধারণের কোনও নিয়ম মানা হয়নি। ফলত এক দেশের ভূখন্ডের চারিদিকে দ্বীপের মত ছোট্ট জমির খণ্ডটি অন্য এক দেশের। স্বাধীনতার পর ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতে। ভারতে এসেছে ৭,১১০ একর জমি। বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭,১৬০ একর জমি। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই সব ছিটমহল দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক হস্তান্তর হয়। কারণ দেশ থাকতেও সেখানকার বাসিন্দারা ছিলেন 'নেই দেশের' নাগরিক। তাঁদের পরিচয় ছিল 'ছিটের লোক'। তাঁরা ছিলেন রাষ্ট্রহীন। নাগরিকত্ব ছিল না কোনও দেশের। জিরো পয়েন্ট বলাই যায়।

Chitmahal Coochbehar Express Photo Shashi Ghosh এমনি করেই যায় যদি দিন...পড়ন্ত দুপুরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন গৃহস্বামী ও গৃহকর্ত্র। ছবি: শশী ঘোষ

ছিটমহলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজব্যবস্থার প্রতীক। কেনই বা দেশ ভাগ হয়েছিল, কিভাবে হয়েছিল, আর এই ভাগের ভৌগলিক সীমা নির্ধারণ কারা করেছিলেন তাঁদের এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন ছিটমহলের মানুষ। কারণ বিনিময়ের পরও সুখে নেই ছিটমহলের অধিবাসীরা। স্বাধীনতার ৬৮ বছর পর তাঁরা দেশের নাগরিক হয়েছেন। কিন্তু মাত্র তিন বছরেই ভবিষ্যত সম্বন্ধে হতাশও হয়ে পড়েছেন।

অতিথি দেব ভব। অতিথি নারায়ন। এমন হাজারো অতিথিসেবার প্রবচন প্রচলিত আছে এই বাংলায়। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় প্রবচন ও বাস্তবের ফারাকটা ক্রমশ বাড়ছে, এটাই অভ্যস্ত চিত্র। কিন্তু আজও যখন কেউ অচেনা মানুষকে হাতে পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করেন, তখন মনে হয় বাংলাটা পুরোপুরি বদলায়নি। ছিটমহলের মানুষদের দেখে মনে হয়, এখনও সামাজিকতার সবটা শেষ হয়ে যায়নি। শেষ হতে দেননি তাঁরা। কিন্তু কেমন আছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা?

Chitmahal Coochbehar Express Photo Shashi Ghosh ছিটমহলে ছিটেবেড়ার বাড়ি। যেখান থেকে গড়ে ওঠে বেঁচে থাকার আন্দোলন। ছবি: শশী ঘোষ

কোচবিহার শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছিটমহল ধবলসতি-মিরগিপুর। একদা বাংলাদেশের এই একরত্তি ভূখণ্ড এখন কোচবিহার জেলার অংশ। একেবারে মেখলিগঞ্জ শহর লাগোয়া। আগে ছিল বাংলাদেশের রংপুর জেলার অন্তর্গত। থানা ছিল পাটগ্রাম। মাত্র শ'দুয়েক গ্রামবাসী রয়েছেন এখানে। পরিবার ৩৮টি। ছিটমহল বিনিময়ের পর প্রায় সমস্ত পরিচয়পত্র, র‍্যাশন, জল, আলো সব পেয়েছে এই জনপদ। কিন্তু এখনও মেলেনি জমির নথি। রেকর্ড, মিউটেশন বা কোনওরকম কাগজ মেলেনি। কাজেই জমি নিয়ে জটিলতা এখনও কাটেনি।

অথচ এদেশে এসেই জীবনে প্রথমবার ভোট দিয়েছেন এখানকার মানুষ। বাংলাদেশে যখন ছিলেন, তখন থানারও প্রয়োজন হত না, কারণ তাঁদের ভালমন্দের খবর রাখতো না বাংলাদেশ সরকার।

তবে কেন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া সত্বেও রাতের ঘুম চলে গিয়েছে দিনুবালা রায়ের? নিজেই স্বীকার করছেন, তাঁর জন্মভূমি কেন বাংলাদেশ ছিল, তা কখনও বুঝে উঠতে পারেন নি। জন্মভূমির অনুভূতিই পান নি কখনও। কিন্তু আজও ভূমির অধিকার থেকে তো তাঁরা বঞ্চিত। দিনুবালার ক্ষোভ, "এদেশে এসে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। কিভাবে তার সমাধান হবে তাও বুঝে উঠতে পারছি না। এর থেকে আগেই আমরা ভাল ছিলাম। তখন জমির কোনও কাগজ না থাকায় বিক্রি করতে অসুবিধা হত না। এখন কেউ জমি কিনছে না। জানি না কী হবে।"

দিনুবালার মেয়ে মমতা রায় পড়াশোনা করছেন মেখলিগঞ্জে। এডুকেশন নিয়ে এমএ করেছেন। মমতা বলেন, "আগে তো ভারতে বসবাসকারী কোনও আত্মীয়র ঠিকানা ব্যবহার করে পড়াশোনা করতে হত। নামেই বাংলাদেশের বাসিন্দা ছিলাম। সবই ছিল ভারতে। দেশবদলে অনেক সমস্যা মিটেছে। তবে কাজের সুযোগ কোথায়?"

Chitmahal Coochbehar Express Photo Shashi Ghosh পুরোনো দিনের স্মৃতি আওড়াচ্ছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। ছবি: শশী ঘোষ

দিনুবালার কথার প্রতিধ্বনি অন্য ছিটমহলবাসীদের কথাতেও। এমনকি আন্দোলনের কথাও বলছেন তাঁরা। অনিল রায় লস্কর বলেন, "আমরা সমস্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাব। ভূখণ্ডের দেশবদল ঘটলেও আমরা এখনও জমির কোনও অধিকার পেলাম না। আইনি জটিলতা আদৌ কবে কাটবে তাও বুঝে উঠতে পারছি না। এখানে বাসিন্দাদের গড়ে ৭-৮ বিঘে জমি রয়েছে। সেই সব জমিতে ধান, পাট, আলু, তামাক চাষ হয়। কিন্তু অনেকেই পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন।"

আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশের হিংসার রাজনীতিও। বাসিন্দাদের মতে, "আগে কখনও বুঝিনি রাজনীতি কী। কারণ বাংলাদেশের বাসিন্দা হলেও ভোটের অধিকার আমাদের ছিল না। তাই ভোট হওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। বিএনপি, আওয়ামী লীগ খায়, না মাথায় দেয়, তাও বুঝতে পারি নি। কিন্তু এখন সেই স্বাদ পেয়েছি।" তাঁদের আশঙ্কা, রাজনীতির টানাটানিতে হানাহানির ঘটনা ঘটবে।

আগে দেশ ছিল না, নিরাপত্তা ছিল না, মানবসমাজের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তাঁরা। সমস্ত বঞ্চনা দূর করতে তাঁরাই যুক্ত হয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে। এখন দেখা যাচ্ছে, যদি, কিন্তু, অতএব...... এসব রয়েই গিয়েছে ছিটের লোকেদের মনের মণিকোঠায়।

Bangladesh north bengal
Advertisment