চন্দ্রযান ৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের সফল অভিযানে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার নাম উজ্জ্বল হয়েছে। উজ্জ্বল হয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর নাম। কিন্তু অনেকেই জানেন না, চাঁদে গহ্বর রয়েছে এক বাঙালি বিজ্ঞানীর নামে। আদতে কোন্নগরের বাসিন্দা এবং আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র ড. শিশিরকুমার মিত্র মহাকাশ গবেষণায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতার-পদার্থবিদ্যা বিভাগের সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। দেশে প্রথম রেডিও সম্প্রচার 'রেডিও টু-সি-জেড' কেন্দ্রের মাধ্যমে চালু করেছিলেন এই বাঙালি পদার্থবিদ। তা-ও আবার মহানগরী কলকাতা থেকেই। চন্দ্রযান ২ অভিযান ব্যর্থ হলেও তার অরবিটার ইসরোর কাছে ছবি পাঠিয়েছিল। সেই ছবিতে ধরা পড়ে চাঁদের মাটিতে অজস্র গহ্বর। যার মধ্যে একটি হল 'মিত্র ক্রেটার'। এই ক্রেটার বা গহ্বরের নাম মিত্র দেওয়া হয়েছে ড. শিশিরকুমার মিত্রর নাম অনুযায়ী।
সেই সময় বাঙালি মেতে উঠেছিল বেলুনের মাধ্যমে বায়ুবিহারে। গড়ের মাঠ থেকে বড় আকারের বেলুনে চড়ে আকাশপথে ভ্রমণ করত বাঙালি। যার নামকরণ করা হয়েছিল বেলুনবিহার। সেনিয়ে ছড়াও তৈরি হয়েছিল- 'উঠল বেলুন গড়ের মাঠে, নামল গিয়ে বসিরহাটে…'। বছর ৭-এর শিশিরকুমার মিত্রের মনে ছড়াটি বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহল তৈরি করেছিল। কীসের সাহায্যে বেলুন আকাশে উড়ছে, তা জানার আগ্রহ তৈরি করেছিল। পরবর্তী সময়ে ভাগলপুরের টিএনজে কলেজ থেকে এফএ পাশ করে শিশিরকুমার ১৯০৮ সালে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে আসেন। ১৯১২ সালে এমএমসি পাশের পর জগদীশচন্দ্র বসুর সহকারি হিসেবে শুরু করেন গবেষণার জীবন।
সিভি রমণের অধীনে পরবর্তীতে আলোকবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল শিশিরকুমার মিত্রের প্রথম গবেষণাপত্র- 'ইন্টারফেরেন্স অ্যান্ড ডিফ্রাকশন অফ লাইট।' ১৯২০ সালে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শুরু করেন গবেষণার নতুন দিক। ১৯২৩ সালে তামার বর্ণালি নিয়ে কাজের সুবাদে দ্বিতীয় ডক্টরেট পান শিশিরকুমার। এরপর মেরি কুরির ইনস্টিটিউট অফ রেডিয়ামের বিজ্ঞানী দলে যোগ দেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ওয়ারলেস টেলিগ্রাফি নিয়ে কাজ করেন। বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার নিয়েও গবেষণা করেন। ১৯৪৩ সালে তাঁর শিশিরকুমার মিত্রের থিওরি, 'রাতের আকাশের আলোকসজ্জা' দেশ-বিদেশে সাড়া ফেলে। আয়োনোস্ফিয়ারের এফ-স্তরে আয়ন এবং ইলেকট্রন রয়েছে, তা তিনি প্রমাণ করেন। N2 আয়ন নিয়ে তাঁর গবেষণা বিপ্লব ঘটায়। তিনি 'থ্রি বডি কলিশন প্রসেস' ব্যাখ্যা করেন। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই, 'অ্যাকটিভ নাইট্রোজেন- এ নিউ থিওরি'। হরিণঘাটায় গড়ে তোলেন দেশের প্রথম আয়োনোস্ফিয়ার ফিল্ড স্টেশন, 'স্পেস এক্সপ্লোরেশন ডে' নামে গবেষণা কেন্দ্র।
আরও পড়ুন- বিজ্ঞানীদের চিন্তা বাড়িয়ে আন্টার্কটিকায় বিপুল সংখ্যক পেঙ্গুইনের মৃত্যু, কারণটা কী?
১৯৫১-৫২ সালে হন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি। মহাকাশ গবেষণায় তিনি লেখেন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তারিত তথ্যে ঠাসা বই, 'দি আপার অ্যাটমোস্ফেয়ার'। ১৯৫৩ সালে তাঁর বইয়ের তথ্য মহাকাশ গবেষণায় ধার নেয় সোভিয়েত রাশিয়া। শিশিরকুমার মিত্রের বই রুশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ১৯৫৮ সালে তিনি পান রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ। ১৯৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে স্বর্ণপদক দিয়ে পুরস্কৃত করে। ১৯৬২ সালে পান রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি। ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করে। বায়ুমণ্ডলের তড়িৎ-চুম্বকীয় স্তর নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানান ইসরোর প্রাণপুরুষ বিক্রম সারাভাই। মহাকাশ গবেষণায় তাঁর অবদানের প্রতীক, চাঁদের গহ্বর তাঁর নামে নামকরণ করার মধ্যে দিয়ে জানানো হয়েছে।