জলপাইগুড়ি লোটাদেবী মন্দিরের পুকুর থেকে বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপদের ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হল অভিনব উদ্যোগ। পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের উদ্যোগে পুকুরের ধারে বসানো হোলো কূর্ম অবতারের মূর্তি।
জলপাইগুড়ি শহর থেকে ছ'কিলোমিটার দূরে করলা ভ্যালি চা বাগান লাগোয়া লোটাদেবীর মন্দির। ভক্তরা প্রতিদিন মন্দিরে পুজো দেওয়ার পর মন্দির লাগোয়া এই দুধপুকুরে নিয়ম করে দুধ, তেল, সিঁদুর, ফুল, বেলপাতা ইত্যাদি দিয়ে পুকুরে বাস করা কচ্ছপদেরও পুজো করতেন। এছাড়াও মাঘী পূর্ণিমার সময়ে মন্দিরের বার্ষিক উৎসবে লাখো মানুষের ঢল নামে। ফল - মারাত্মক দূষণ।
এই দুধপুকুরে রয়েছে Indian Roofed Turtle। গত কয়েক বছর ধরে কচ্ছপদের উপর লাগাতার সার্ভে চালায় স্পোর নামে এক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন। সার্ভে রিপোর্টে উঠে আসে একটি অপ্রীতিকর তথ্য। বছর দশেক আগেও শতাধিক কচ্ছপ ছিলো এই পুকুরে, যা ক্রমশ কমে দাঁড়ায় খান কুড়িতে।
আরও পড়ুন: জলের অভাবে সঙ্কটে কার্শিয়াং, অভিযোগ জল চুরির
স্পোরের সম্পাদক শ্যামাপ্রসাদ পান্ডে জানান, "জলে নাইট্রোজেন সহ অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন কচ্ছপ মারা যাচ্ছিল, অন্যদিকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পুকুর ছেড়ে অন্যত্র সরে যাচ্ছিল তারা। কচ্ছপদের ফিরিয়ে আনতে আমরা মন্দির কমিটির সাথে আলোচনার পর এই রিপোর্ট পাঠাই দিল্লির ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়াকে। রিপোর্ট পেয়ে ট্রাস্ট আমাদের জলাশয়টি সংস্কার করবার জন্য দুটি পর্যায়ে তিনটি কাজ করবার জন্য প্রাথমিক ভাবে দেড় লক্ষ টাকা দেয়। এবং আগামী এক বছরে এই কাজগুলো করতে বলা হয়।"
কী সেই কাজ? এক, ২০০ বর্গমিটারের এই পুকুরকে প্রথমে সংস্কার, এবং তারপর পুকুরকে ঘের দেওয়া; দুই, মন্দিরে মানুষের আসা যেমন বন্ধ করা যাবে না, তেমনি বন্ধ করা যাবে না তাঁদের পুজোর সামগ্রী আনা (দুধ, সর্ষের তেল ইত্যাদি)। তাই সরাসরি পুকুরের পাশে কূর্মদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুকুরে যাওয়ার বদলে সেখানে পুজোর কাজ করতে দেওয়া। এবং ছোট একটি জলাধার নির্মাণ করে অপরিশোধিত জল বালি ও কাঠকয়লার মধ্যে দিয়ে ফিল্টার করে আবার পুকুরে ফিরিয়ে দেওয়া; তিন, পুকুরের ধারে মাটি, বালি ইত্যাদি প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে কচ্ছপের প্রজনন ক্ষেত্র তৈরী করা।
ফান্ড হাতে পাওয়ার পরই সময় নষ্ট না করে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজে নেমে পড়েন স্পোরের সম্পাদক সহ অন্যান্য সদস্যরা। চলতি বছরের প্রথম দিকে শুরু হয় পুকুর সংস্কারের কাজ। অতিরিক্ত প্রায় ৫০ বর্গফুট এলাকা নতুন করে খোড়া হয়। লাগানো হয় জলজ উদ্ভিদ। কচ্ছপদের জন্য মাটি, বালি ইত্যাদি দিয়ে করা হয় দুটি প্রজনন ক্ষেত্র। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় পুকুরপাড়। স্থাপন করা হয় কূর্ম অবতারের মূর্তি। পূজোর জল পরিশোধনের জন্য পাশেই বসানো হয় ফিল্টার প্রজেক্ট।
আরও পড়ুন: মিটেছে রেলের সব চাহিদাই, কিন্তু আজও অবহেলিত পীরতলা স্টেশন
শ্যামাপ্রসাদবাবু জানান, "পুকুরে কচ্ছপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল কুড়িতে। আমরা সংস্কার চালানোর পর মাত্র ছ'মাসে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছি। এখন পুকুরে তাকালেই দেখতে পাবেন ১৫-২০ টি ছানাকে। এই কাজ মন্দির কমিটি ও স্থানীয়দের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব ছিলো।"
মন্দির কমিটির সদস্য অরুণ কর জানান, "কচ্ছপ বাস করে এমন পুকুর জলপাইগুড়িতে আর নেই। সেই পুকুর থেকে ক্রমেই কচ্ছপ কমে যাচ্ছিলো। পুকুর সংস্কারের ফলে মাত্র একটি বর্ষা পার হতেই এই উন্নতি হবে আমরা ভাবতে পারিনি। আগে রাত হলেই পুকুরপাড়ে প্রচুর শেয়াল আসতো। কচ্ছপের ডিম খেয়ে পালাতো। এবার কাঁটাতারের বেড়ার ফলে আর ঢুকতে পারছে না। পাশেই কূর্ম অবতারের মূর্তি বসানোয় ভক্তদের আর পুকুরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। হাতেনাতে ফল পেয়ে আমরা খুব খুশি।"