International Women's Day 2025: দু'চোখে নেই আলো, ছাপোষা ঘরের মেয়েটির অদম্য জেদ আর লড়াইয়ের কাহিনী শিহরণ জাগাবে

Women’s Day 2025: নারী দিবস মানে আপনার কাছে? আত্মবিশ্বাসী গলায় তিনি আবার বলেন, "আমি বলি মেয়েদের এগিয়ে যেতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না! আমি এই বয়সে এসে নাচ শিখছি। ইচ্ছে ছিল ইচ্ছে পূরণ করছি। থেমে থাকলে, থেমে যেতে হবে। মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে।"

author-image
Shashi Ghosh
New Update
International Women's Day Special

দু'চোখে নেই আলো, অদম্য জেদ আর লড়াইয়ের কাহিনী শিহরণ জাগাবে Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)

Women’s Day 2025 Special : সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’ ছবিটার কথা মনে পড়ে? মাধবী মুখার্জি? আরতি মজুমদারের ভূমিকায়! যেখানে এক নতুন নারীকে পোটট্রে করার চেষ্টা করেছিলেন সত্যজিৎ বাবু! বন্ধ কারখানার শ্রমিকের স্ত্রী সেই মেয়েটি যে অর্থ উপার্জনের জন্য চৌকাঠ পেরোয়। সংসারকে বুঝতে শেখায়। জীবনের প্রথম উপার্জন হাতে পেয়ে তার আত্মপরিচয়ের আলোয় তার মুখখানি প্রস্ফুটিত হয়। আরও সুন্দর হয়ে ওঠে! সাদা কালোর ফ্রেমের ছবিতেও ঠিকরে আসে আলো। এই আলো আসলে, নতুন পরিচয়ের। একজন নারী, সে কম কিসে? পরিচালক সহজ ভাষায় দর্শকদের মনে দাগ কেটে দিয়েছিলেন। প্রায় ছ’দশক পেরিয়ে গিয়েছে। এত সুন্দরদৃশ্যটি বুকের ভিতর বার বার নাড়া দেয়! স্তব্ধ করে রাখে! একজন ছাপোষা ঘরের মেয়ে। যাদের আমরা ট্রেনে, বাসে, ট্রামে রাস্তায় হামেশায় দেখি। এদের প্রত্যেকের একটা না জানা, না বলা লড়াই আছে। আছে বেঁচে থাকার একটা গল্প। 
Advertisment
International Women’s Day 2025:
হাতিবাগান মোড় থেকে ট্রাম লাইন ধরে খানিকটা এগোলে সরু একটা গলির মধ্যে মাম্পির এক চিলতে ঘর Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
ঠিক যেমনটা রয়েছে মাম্পির। পুরো নাম মাম্পি দে। স্টার থিয়েটারকে পিছনে ফেলে। হাতিবাগান মোড় থেকে ট্রাম লাইন ধরে খানিকটা এগোলে সরু একটা গলির মধ্যে মাম্পির এক চিলতে ঘর। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরেই মা মেয়ের সংসার। ঘর ছোট হলেও মাথার উপর আকাশটা অনেক বড়, মেয়েটিকে দেখলে তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। ছোট থেকেই চোখের সমস্যা। দৃষ্টিশক্তি নেই। তাতেও কুছ পরোয়া নেহি। ভগবান চোখ নিয়েছেন তার পরিবর্তে দিয়েছেন অনেক কিছুই। হাতে ব্রেলের বইটা নিয়ে বলছিলেন মাম্পি। "আমার ছোট থেকেই চোখের সমস্যা। চোখের রেটিনার সমস্যার জন্য দু বছর বয়স থেকে দৃষ্টিশক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলি"। তখন থেকেই বেঁচে থাকার লড়াই শুরু। দরজার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়ের কথা শুনছিলেন মা বিভা রাণী দে।
Advertisment
Women’s Day 2025
আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতনই মাম্পি Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
ফাল্গুন মাসের শেষ। রোদের তেজে ঝাঁজ বাড়ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্যাঁতস্যাঁতে উঠোনের মাঝে তুলসীর গাছের ওপর এসে পড়েছে বিকেলের আলো। চারদিকে এদিক সেদিক ঝোলানো কাপড় জামা। পুরনো বাড়ি। চলদা ওঠা দেওয়াল। একসাথে অনেকগুলো পরিবার গাদাগাদি করে রয়েছে। মাঝ বরাবর দাঁড়ালে কোনার দিকের ঘরটায় মাম্পীদের। অঙ্গনওয়াড়ি থেকে বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরে। দু চার গ্রাস মুখে পুড়ে আবার গানের স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়। ছুটির দিন ছাড়া এই রুটিনের ব্যতিক্রম হয়না। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মা সেলাইয়ের কাজ করতেন। মেয়ে দৃষ্টিহীন জেনেও মেয়েকে কোনোদিন আলাদা চোখে দেখেনি। পাঁচটা সাধারণ ছেলে মেয়ের মতনই বড় করেছে। "আমি ওর ছোট থেকেই  দৌড়ে বেড়িয়েছি। মেয়ে দেখতে পায়না এমন বলে আশ্রমে দিয়ে দেব তা তো নয়! ওর বাবা লেদ মেশিনের কাজ করত। পড়াশুনার প্রতি আগ্রহটা আমি আর ওর বাবাই ওর মধ্যে ঢুকিয়েছিলাম। আমার স্বামী, শ্বশুর ভালো গান জানতেন। মেয়েও তার বাবার কাছ থেকে গানটা শিখেছিল।" এসব মাম্পির মা বলছিলেন। 
womens day special
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মা সেলাইয়ের কাজ করতেন। মেয়ে দৃষ্টিহীন জেনেও মেয়েকে কোনোদিন আলাদা চোখে দেখেনি। পাঁচটা সাধারণ ছেলে মেয়ের মতনই বড় করেছে। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
নারী দিবস মানে আপনার কাছে? আত্মবিশ্বাসী গলায় তিনি আবার বলেন, "আমি বলি মেয়েদের এগিয়ে যেতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না! আমি এই বয়সে এসে নাচ শিখছি। ইচ্ছে ছিল ইচ্ছে পূরণ করছি। থেমে থাকলে, থেমে যেতে হবে। মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে।"
Happy Women's Day 2025
দু'চোখে নেই আলো, তবু কন্ঠে আছে সুর Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
একবিংশ শতাব্দীতে এসে মেয়েরা নিজেদের অধিকার নিজেরা বুঝে নিতে শিখছে। সময় এগিয়েছে। বদলেছে যুগ। সাদা কালো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টেলিভিশনও বদলে এখন এলইডি এসেছে। সমাজে নারীর মর্যাদার পাল্লা কিছুটা হলেও ভারী হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো শুধু মর্যাদার নয়। সম্মান আদায়ের লড়াইয়ে নারী কি আদৌ সফল হয়েছে? "নারী পুরুষ এরা দুটো লিঙ্গ মাত্র। এছাড়া কিছুই নয়! এই সমাজে ছেলেরা যা পারে। মেয়েরাও তার থেকে কম কিছু না পেরে থাকে না। এই সমাজের মানুষই বিভেদ তৈরি করে নারী পুরুষের মধ্যে"। মাম্পি গানের স্কুলের পথে হেঁটে যাওয়ার সময় বলছিলেন। 
shashi ghosh story on womens day
গানের স্কুলে বসেই ছাত্রদের সামনে বলে যাচ্ছিল মাম্পি। মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে হা করে শুনছিল সকলে। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
হাতের লাঠিটা ধরে হনহনিয়ে হাঁটছিল। এটায় পরম বন্ধু। কথা বলতে গিয়ে গানের স্কুলের রিহার্সাল অনেকটায় দেরি হয়ে গিয়েছে। সামনে থেকে দেখলে বোঝা যায় উত্তর কলকাতার সর্পিল গুলিগুলো হাতের তালুর মতন স্পষ্ট। চোখের দৃষ্টি কম হলেও কিন্তু শিক্ষার আলো তিনি নিভে যেতে দেয়নি।
What is the significance of International Women’s Day for 2025?
ঘর ছোট হলেও মাথার উপর আকাশটা অনেক বড়, মেয়েটিকে দেখলে তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই ছোট থেকে লড়াই করছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাশ। এরপর  নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পেশাল বিএড। অঙ্গনওয়াড়িতে চাকরির পাশাপাশি,একটি গানের স্কুলেও গানও শেখান। বিকেল হলেই দিদিমণির অপেক্ষায় বসে থাকে ছাত্ররা। 
blind women story
গানের স্কুলে স্বমেজাজে Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতনই মাম্পি। আলাদা করে করুণ দৃষ্টিতে দেখার তালিকায় তাঁর নাম না ফেললেও চলবে। বরং অদম্য জেদ আর সাহসটুকু নেওয়া যেতে পারে । মহিলাদের লড়াইটা শুরু কোথা থেকে? "মহিলাদের লড়াইটা আসলে শুরু নিজের ঘর থেকে। ছোটবেলায় প্রথম শেখানো হয় তুমি মেয়ে! তুমি এই কাজটা করবে না। কেন? এটা যদি না শেখানো হয়, তবেই মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপন হবে। এই যেমন তুমি মেয়ে ওই রাস্তায় যাবে না। তুমি মেয়ে ওই জামাটা পড়বে না। বা একটা ছেলেকে বলবে না তুমি রান্নাবাটি নিয়ে খেলবে না। একটা ছেলে যেমন রান্না করবে তেমনি একটা মেয়ে বাইরে কাজ করবে। এটায় স্বাভাবিক। প্রতিবন্ধকতা শারীরিক নয়। এটা মানসিক। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে যাদের আমরা প্রতিবন্ধী বলি তাঁরা অনেক বেশি শিক্ষিত। আগে নিজের মনের প্রতিবন্ধকতা সংশোধন করতে হবে।" গানের স্কুলে বসেই ছাত্রদের সামনে বলে যাচ্ছিল মাম্পি। মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে হা করে শুনছিল সকলে। 
significance of International Women’s Day for 2025?
দরজার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়ের কথা শুনছিলেন মা বিভা রাণী দে। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
'নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে।' ১৯৫৯ সালে সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছিলেন। শিশু তার লিঙ্গ সম্পর্কে সচেতন থাকে না। চুলে ফিতে বেঁধে, ফ্রক পরিয়ে, হাতে পুতুল তুলে দিয়ে তাকে 'নারী' হিসেবে নির্মাণ করে সমাজ। 'নির্মাণ' কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না। সব জায়গায় একটা অবদমনের চেষ্টা চলেছে। যদিও এই অবদমন শব্দগুলো এখন ঠুনকো মাম্পির মতন মেয়েদের কাছে। এরা সহজে শেকল ভাঙ্গতে জানে। 
What are India's Initiatives Toward Women-Led Development?
ঈশ্বর যতটুকু কেড়ে নিয়েছে তার থেকে বেশি দিয়েছে। আঙ্গুল চলতে থাকে হারমোনিয়ামে। গলায় সুর ওঠে। গানের তালে চোখ বুজে আসে মাম্পির। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
ঈশ্বর যতটুকু কেড়ে নিয়েছে তার থেকে বেশি দিয়েছে। আঙ্গুল চলতে থাকে হারমোনিয়ামে। গলায় সুর ওঠে। গানের তালে চোখ বুজে আসে মাম্পির। হয়তো মনের ভিতরেই দেখতে এক অন্যরকম পৃথিবীর ছবি। যা আমরা কেউ চোখ থেকেও দেখতে পায়নি আজও।
Government Programs Promoting Women’s Empowerment
অঙ্গনওয়াড়িতে চাকরির পাশাপাশি,একটি গানের স্কুলেও গানও শেখান। বিকেল হলেই দিদিমণির অপেক্ষায় বসে থাকে ছাত্ররা। Photograph: (এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ)
 
International Women’s Day