আগেই তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিয়ে নোংরা রাজনীতির অভিযোগ করেছেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। এবার একধাপ এগিয়ে নিজেকে জাতীয়তাবাদী মুসলিম বলে দাবি করলেন। একইসঙ্গে অভিযোগ করলেন যে তাঁর মত জাতীয়তাবাদী মুসলিম মুখকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পছন্দ করেন না। তৃণমূল সুপ্রিমো চান বোমা বানানোয় ওস্তাদ মুসলিম নেতাদের। দিনকয়েক আগেই পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপত্র জমাকে কেন্দ্র করে ভাঙড়-সহ বিভিন্ন জায়গায় আইএসএফ-তৃণমূল সংঘর্ষ বারবার শিরোনামে এসেছে। একইসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে আরাবুল ইসলাম, শওকত মোল্লা-সহ একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। সেসব নিয়েই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মুখোমুখি হলেন আইএসএফের একমাত্র বিধায়ক।
প্রশ্ন- রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার দুই বছর পর বাংলার রাজনীতিকে কীভাবে দেখছেন?
সিদ্দিকি- প্রথম দিকে আমার রাজনীতিতে অনীহা ছিল। আমি সামাজিক কাজ এবং দাতব্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কিন্তু, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সামাজিক কাজ এবং দাতব্যের মাধ্যমে মানুষকে খুব বেশি সাহায্য করা যাবে না। রাজনীতিতে যোগদান এবং শাসনের অংশ হওয়ার পরেই আমি অনুভব করেছি যে প্রকৃতই মানুষকে সাহায্য করতে পারি। ২০২১ সালে, যখন আইএসএফ গঠিত হয়েছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং টিএমসি-র আধিপত্য ছিল। ভাঙড়ের মানুষ এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে গিয়েছেন, আমাকে আশীর্বাদ করেছেন এবং আমি জিতেছি। আমি বিধানসভায় একমাত্র অবিজেপি বিরোধী বিধায়ক হয়েছি। এরপর সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন- জানুয়ারিতে, কলকাতার এসপ্ল্যানেডে একটি সমাবেশের পরে আপনি গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং হত্যার চেষ্টার অভিযোগে ৪১ দিন জেলে ছিলেন। এখনও কি, মনে পড়ে সেইসব দিনগুলোর কথা?
সিদ্দিকি- ২১শে জানুয়ারি কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে আমাদের সমাবেশের সময় পুলিশ কীভাবে আমাকে ভ্যানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তা সবাই দেখেছে। আমার অপরাধ ছিল, আমি জনগণের মধ্যে তাঁদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ছড়াচ্ছিলাম। এটা এমন একটা সময়ে, যখন মানুষ সব (রাজনৈতিক দল) দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছিল। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি ছিল, কিন্তু উন্নয়নের নয়। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, আমি পুলিশ হেফাজতে এবং তারপর জেল হেফাজতে ছিলাম। উভয় জায়গায়, আমি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট প্রত্যাখ্যান করেছি এবং সাধারণ আসামিদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করেছি। এটি একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। আমি জেলের খাবার খেয়েছি এবং তার জল পান করেছি। সেই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকর সুন্দর।
প্রশ্ন- বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে আপনার দলের জোটকে কীভাবে দেখছেন?
সিদ্দিকি- ফুরফুরা শরিফ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এখন এত বছর পর সেই ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য ক্ষমতা দখল নয়, সামাজিক পরিবর্তন। আইএসএফ গঠনের পর, আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে আমরা অবিজেপি এবং অটিএমসি বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত। হ্যাঁ, ওটাই। আমরা দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং অন্যান্যদের জন্য কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন- এই বছরের শুরুতে, কংগ্রেস সাগরদিঘি থেকে উপনির্বাচনে জিতে এবারের বিধানসভায় প্রথম বিধায়ক পেয়েছিল। তবে সম্প্রতি, সেই কংগ্রেস বিধায়ক টিএমসিতে যোগ দিয়েছেন। আপনার ওপরও কি তাদের চাপ আছে?
সিদ্দিকি- যখন আইএসএফ তৈরি হয়েছিল, তখন আমরা ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। আমি ভাঙার বদলে জয়ী হওয়ার পর, আমার পছন্দের নগদ এবং একটি মন্ত্রী পদের অফার ছিল। শুরুতে শীর্ষ নেতারাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যাখ্যান করা হলে, ভাঙ্গড়ের স্থানীয় নেতারা যোগাযোগ করেন, যাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। এমনকী, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মাধ্যমেও মেসেজ এবং অফার এসেছে। যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখন টিএমসির সঙ্গে আছেন, যাঁদের সাথে আমি যোগাযোগ রেখেছিলাম। কিন্তু, আমরা প্রতিবারই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। ভাঙড়ের জনগণ আমাকে নির্বাচিত করে আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন, তা আমি ভাঙতে পারব না। বাংলায় এমন অনেক দলবদলু আছে। আমার মতে, আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণেও যদি কেউ দল ছাড়ার কথা ভাবেন, তাহলে একজন বিধায়ক হিসেবে পদত্যাগ করে ভোটের মাধ্যমে জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন।
প্রশ্ন- সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের সময় ভাঙ্গড়ে টিএমসি কর্মীদের সঙ্গে আইএসএফ কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, যাতে তিন জন নিহত হয়েছে, এই ব্যাপারে কী বলবেন?
সিদ্দিকি- ভাঙড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা হিংসা চায় না। যা ঘটেছিল, তা হল মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় (পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য) আমাদের ওপর গুলি এবং বোমা বর্ষণ হয়েছিল। লোকেরা প্রতিবাদ করেছিল। তাঁরা শুধু তাঁদের অধিকার চায়- ভোট দিতে এবং নির্বাচনে মনোনয়ন জমার অধিকার। তাঁরা শুধু তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান, যা বর্তমানে তাঁদের জন্য অনুমোদিত নয়। আমি সবসময় শান্তির আবেদন জানিয়েছি।
আরও পড়ুন- মমতা-অভিষেকের চরম পদক্ষেপ, কোপে তৃণমূলের ৫৬ নেতা-কর্মী!
প্রশ্ন- টিএমসি নেতৃত্ব তো আপনাকেই ভাঙড়ের হিংসার জন্য দায়ী করেছেন?
সিদ্দিকি- নওশাদ সিদ্দিকির মতো জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সংখ্যালঘু মুখ উঠে আসছে, তা তাঁরা হজম করতে পারছেন না। এ কারণেই তাঁরা আমাকে একজন দাঙ্গাকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। তাঁর (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আরাবুল ইসলাম এবং সওকত মোল্লার মতো মুসলিম নেতাদের প্রয়োজন, যাঁরা হয় বোমা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ বা মহিলা অধ্যাপকের (যার জন্য আরাবুল ইসলাম অভিযুক্ত) দিকে জগ ছুড়ে মারতে পারেন। কিন্তু, নওশাদ সিদ্দিকি মুসলমানদের মূল স্রোতে নিয়ে আসছেন, তিনি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তাই তাঁরা আমাকে সহ্য করতে পারছেন না।