কুমারী মহিলাদের সঙ্গে সিলড বোতলের তুলনা তো হালের ঘটনা। কনক সরকারের বহুবিধ ‘রিগ্রেসিভ’ বক্তব্যের সঙ্গে যাদবপুরের পরিচয় প্রায় আড়াই দশকের। বস্তুত, এসব কার্যত গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ পড়ুয়া, শিক্ষকের। আচমকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পুরনো পাপী’ কনকের বিরোধিতায় নেটিজেনদের সরব হতে দেখে তাঁরা খুশি তো বটেই, সঙ্গে অবাকও।
প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার সকাল বা দুপুরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মিলনদার ক্যান্টিন চত্ত্বরে গেলেই দেখা যায়, মধ্যবয়স পেরিয়ে আসা এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। ঈষৎ মলিন পোশাক। তিনিই কনক সরকার। পেশায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানও বটে। প্রায়শই দেখা যায়, এক বা একাধিক ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের কিছুটা জোর করেই দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ করছেন কনক। কখনও তাঁর তীরে বিদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন উপাচার্য, কখনও তিনি কুকথা বলেন শিক্ষক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় এক দম্পতিকে উদ্দেশ্য করে। মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে জোর গলায় নিজের তৈরি বিভিন্ন তত্ত্বের প্রচার করেন। তাঁর মতে নারীবাদীদের বাড়বাড়ন্তের কারণেই নাকি সমাজ-সংসার উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। খেয়াল করে দেখলে নাকি জানা যেত, সর্বত্র পুরুষরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হন! এছাড়া মহিলাদের যৌনাচার, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে বিবিধ বক্তব্য তো রয়েইছে। নিয়মিত ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপেও এসব লেখেন তিনি।
কনকের মতে, যাদবপুরের মান আগের চেয়ে কমেছে, কারণ ছাত্রীরা সাহসী পোশাকে ক্যাম্পাসে আসেন, সিগারেট খান, বিয়ের আগেই যৌনতায় জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ, ক্লাসের চেয়ে ক্যান্টিনেই বেশি সময় কাটান ওই অধ্যাপক। ঘনিষ্ঠ মহলে একবার তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর কাছে বিগত আড়াই দশকে ক্যাম্পাসের যাবতীয় কেচ্ছাকাহিনীর ডকুমেন্ট রয়েছে। সেসব পেপার কাটিং তিনি একাধিক ফাইলে জমিয়ে আলমারিতে তুলে রেখেছেন।
আরও পড়ুন: এনআরএস-এর কুকুর নিধন কাণ্ডে ধৃত দুই নার্সিং কর্মী
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা কনক যাদবপুরে পড়াতে শুরু করেন ন'য়ের দশকের শেষে। আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের সেই সময়ের পড়ুয়া অনিন্দ্য দাশগুপ্ত বলেন, "ক্লাসে প্রায় রোজই উনি আপত্তিকর মন্তব্য করতেন। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ হত, কিন্তু হাজার বলা সত্ত্বেও উনি বদলাতেন না। কাঁহাতক আর একটা লোকের পিছনে পড়ে থাকা যায়! তাই ইগনোর করতাম।" তাঁর কথায়, "পাশ করে যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। শুনতাম, উনি একই রকম রয়ে গিয়েছেন। ফেসবুকে আসার পর তো প্রকাশ্যেই একের পর এক কুরুচিপূর্ণ, সেক্সিস্ট মন্তব্য করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম সেসব নিয়ে অনেকে সরব হতেন। কিন্তু উনি পাত্তাই দিতেন না। ফলে ফেসবুকের প্রতিবাদও থিতিয়ে এল। সবাই প্রায় ধরে নিয়েছিল উনি এমনটাই করবেন। কিন্তু এই পোস্টে দেখলাম আচমকা বাঁধ ভেঙে গেল।"
যাদবপুরে কনক প্রথম থেকেই বাম বিরোধী হিসাবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গে ছাত্রজীবনে দক্ষিণপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতেন। কোনও শিক্ষক সংগঠনে সক্রিয় না থাকলেও একসময় তৃণমূলপন্থী ওয়েবকুপার (WBCUPA) সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাম প্রভাবিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (JUTA) এক নেতার কথায়, "উনি চিরকাল দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। প্রথমে তৃণমূলের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন, সম্প্রতি বিজেপির বুদ্ধিজীবী মহলে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। আমরা ওঁর এই কুৎসিত মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি।"
ওয়েবকুপার নেতা মনোজিত মণ্ডল অবশ্য কনকের তৃণমূল যোগের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, "উনি কোনওদিনই আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। কয়েক বছর আগে ওয়েবকুপার সদস্য হতে চেয়ে দরখাস্ত করেছিলেন। আমরা নিইনি। আমি যতদূর জানি, উনি আবুটার সদস্য।" এসইউসি প্রভাবিত অল বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন বা আবুটার যাদবপুরের নেতা গৌতম মাইতি বলেন, "শিক্ষক সংগঠনে বহুজন বহুসময় মেম্বারশিপ নেন। কনক হয়তো কোনও একসময় আমাদের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। কিন্তু চাঁদাপত্র কিছুই দিতেন না। আমাদের সঙ্গে ওঁর কোনও যোগাযোগ নেই।" তাঁর কথায়, "যে অতীব জঘন্য মন্তব্য উনি করেছেন, আমরা তাকে ধিক্কার জানাই। এমন মন্তব্য বিকৃত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ।" প্রসঙ্গত, সম্প্রতি #মিটু বিতর্কেও নাম জড়িয়েছিল কনকের। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন একাধিক ছাত্রী।
কনকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে একাধিক ছাত্র সংগঠন। আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আকাশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আগেও বহুবার কনকবাবুর এই ধরণের মন্তব্য নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু ফল মেলেনি। আশা করি এবার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।"
‘উনি তো চিরকালই এমন!’ বলছেন পড়ুয়া-প্রাক্তনীরা
যাদবপুরে কনক প্রথম থেকেই বাম বিরোধী হিসাবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গে ছাত্রজীবনে দক্ষিণপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতেন। কোনও শিক্ষক সংগঠনে সক্রিয় না থাকলেও একসময় তৃণমূলপন্থী ওয়েবকুপার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।
Follow Us
কুমারী মহিলাদের সঙ্গে সিলড বোতলের তুলনা তো হালের ঘটনা। কনক সরকারের বহুবিধ ‘রিগ্রেসিভ’ বক্তব্যের সঙ্গে যাদবপুরের পরিচয় প্রায় আড়াই দশকের। বস্তুত, এসব কার্যত গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল অধিকাংশ পড়ুয়া, শিক্ষকের। আচমকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পুরনো পাপী’ কনকের বিরোধিতায় নেটিজেনদের সরব হতে দেখে তাঁরা খুশি তো বটেই, সঙ্গে অবাকও।
প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার সকাল বা দুপুরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মিলনদার ক্যান্টিন চত্ত্বরে গেলেই দেখা যায়, মধ্যবয়স পেরিয়ে আসা এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। ঈষৎ মলিন পোশাক। তিনিই কনক সরকার। পেশায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানও বটে। প্রায়শই দেখা যায়, এক বা একাধিক ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের কিছুটা জোর করেই দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ করছেন কনক। কখনও তাঁর তীরে বিদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন উপাচার্য, কখনও তিনি কুকথা বলেন শিক্ষক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় এক দম্পতিকে উদ্দেশ্য করে। মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে জোর গলায় নিজের তৈরি বিভিন্ন তত্ত্বের প্রচার করেন। তাঁর মতে নারীবাদীদের বাড়বাড়ন্তের কারণেই নাকি সমাজ-সংসার উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। খেয়াল করে দেখলে নাকি জানা যেত, সর্বত্র পুরুষরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হন! এছাড়া মহিলাদের যৌনাচার, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে বিবিধ বক্তব্য তো রয়েইছে। নিয়মিত ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপেও এসব লেখেন তিনি।
কনকের মতে, যাদবপুরের মান আগের চেয়ে কমেছে, কারণ ছাত্রীরা সাহসী পোশাকে ক্যাম্পাসে আসেন, সিগারেট খান, বিয়ের আগেই যৌনতায় জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ, ক্লাসের চেয়ে ক্যান্টিনেই বেশি সময় কাটান ওই অধ্যাপক। ঘনিষ্ঠ মহলে একবার তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর কাছে বিগত আড়াই দশকে ক্যাম্পাসের যাবতীয় কেচ্ছাকাহিনীর ডকুমেন্ট রয়েছে। সেসব পেপার কাটিং তিনি একাধিক ফাইলে জমিয়ে আলমারিতে তুলে রেখেছেন।
আরও পড়ুন: এনআরএস-এর কুকুর নিধন কাণ্ডে ধৃত দুই নার্সিং কর্মী
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, আদতে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা কনক যাদবপুরে পড়াতে শুরু করেন ন'য়ের দশকের শেষে। আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের সেই সময়ের পড়ুয়া অনিন্দ্য দাশগুপ্ত বলেন, "ক্লাসে প্রায় রোজই উনি আপত্তিকর মন্তব্য করতেন। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ হত, কিন্তু হাজার বলা সত্ত্বেও উনি বদলাতেন না। কাঁহাতক আর একটা লোকের পিছনে পড়ে থাকা যায়! তাই ইগনোর করতাম।" তাঁর কথায়, "পাশ করে যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। শুনতাম, উনি একই রকম রয়ে গিয়েছেন। ফেসবুকে আসার পর তো প্রকাশ্যেই একের পর এক কুরুচিপূর্ণ, সেক্সিস্ট মন্তব্য করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম সেসব নিয়ে অনেকে সরব হতেন। কিন্তু উনি পাত্তাই দিতেন না। ফলে ফেসবুকের প্রতিবাদও থিতিয়ে এল। সবাই প্রায় ধরে নিয়েছিল উনি এমনটাই করবেন। কিন্তু এই পোস্টে দেখলাম আচমকা বাঁধ ভেঙে গেল।"
যাদবপুরে কনক প্রথম থেকেই বাম বিরোধী হিসাবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গে ছাত্রজীবনে দক্ষিণপন্থী ছাত্র রাজনীতি করতেন। কোনও শিক্ষক সংগঠনে সক্রিয় না থাকলেও একসময় তৃণমূলপন্থী ওয়েবকুপার (WBCUPA) সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাম প্রভাবিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (JUTA) এক নেতার কথায়, "উনি চিরকাল দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। প্রথমে তৃণমূলের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন, সম্প্রতি বিজেপির বুদ্ধিজীবী মহলে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। আমরা ওঁর এই কুৎসিত মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি।"
ওয়েবকুপার নেতা মনোজিত মণ্ডল অবশ্য কনকের তৃণমূল যোগের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, "উনি কোনওদিনই আমাদের সঙ্গে ছিলেন না। কয়েক বছর আগে ওয়েবকুপার সদস্য হতে চেয়ে দরখাস্ত করেছিলেন। আমরা নিইনি। আমি যতদূর জানি, উনি আবুটার সদস্য।" এসইউসি প্রভাবিত অল বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন বা আবুটার যাদবপুরের নেতা গৌতম মাইতি বলেন, "শিক্ষক সংগঠনে বহুজন বহুসময় মেম্বারশিপ নেন। কনক হয়তো কোনও একসময় আমাদের সদস্যপদ নিয়েছিলেন। কিন্তু চাঁদাপত্র কিছুই দিতেন না। আমাদের সঙ্গে ওঁর কোনও যোগাযোগ নেই।" তাঁর কথায়, "যে অতীব জঘন্য মন্তব্য উনি করেছেন, আমরা তাকে ধিক্কার জানাই। এমন মন্তব্য বিকৃত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ।" প্রসঙ্গত, সম্প্রতি #মিটু বিতর্কেও নাম জড়িয়েছিল কনকের। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন একাধিক ছাত্রী।
কনকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে একাধিক ছাত্র সংগঠন। আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আকাশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আগেও বহুবার কনকবাবুর এই ধরণের মন্তব্য নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু ফল মেলেনি। আশা করি এবার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।"