Advertisment

প্রতিবন্ধকতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে যুদ্ধ-জয়! পা দিয়েই মাধ্যমিক দিচ্ছে মেমারির জগন্নাথ, লড়াইকে কুর্নিশ

কুর্নিশ জানাচ্ছেন পরীক্ষকরাও।

author-image
Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Jagannath Mandi 1

জগন্নাথ মান্ডি, ছবি- প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

জন্মের সময় থেকেই দুটি হাত যেন থেকেও নেই। খর্বকায় দুটি হাতে নেই তালু, নেই আঙুলও। কিন্তু, তাতে আর কী যায় আসে? শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছাত্র জগন্নাথ মান্ডি। পা দিয়ে লিখেই এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। অবশ্য কী নেই, তা নিয়ে জগন্নাথের কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং, পরীক্ষায় সফল হওয়ার ব্যাপারে সে দৃঢ়প্রত্যয়ী। লেখাপড়া শেখার জন্য বিশেষ ভাবে সক্ষম আদিবাসী পরিবারের এই ছাত্রের এহেন লড়াইকে কুর্নিশ না-জানিয়ে পারেননি পরীক্ষাকেন্দ্রের পরীক্ষকরাও।

Advertisment

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জগন্নাথ মান্ডির বাড়ি মেমারি থানার সিমলা গ্রামের আদিবাসী পাড়ায়। তাঁর শৈশব জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মেছে জেনে ছোটবেলাতেই তাঁকে ছেড়ে চলে যায় মা। তবে মা ছেড়ে চলে গেলেও বাবা, বৃদ্ধা ঠাকুমা এবং পিসি ও দাদার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি জগন্নাথ। তাঁদের পরম স্নেহে জগন্নাথ লালিত-পালিত হয়।

তাঁরাই লেখাপড়া শেখার প্রতি জগন্নাথকে ছোট বয়স থেকে আগ্রহী করে তোলেন। ভর্তি করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই পা দিয়ে বাংলায় লেখা রপ্ত করতে শুরু করে জগন্নাথ। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ পা দিয়ে লেখায় সাবলীল হয়ে ওঠে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পূর্ণ হলে পরিবারের লোকজন জগন্নাথকে ভর্তি করে মেমারির নুদিপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে। সেখানে একের পর এক ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে এবার জগন্নাথ দিচ্ছে মাধ্যমিক।

এলাকার সবথেকে বড় আদিবাসী পাড়া সিমলা থেকে জগন্নাথই একমাত্র ছাত্র যে এবার মাধ্যমিক দিচ্ছে। এমন এক ছাত্রের পরীক্ষা দিতে যাতে কোনও অসুবিধা না-হয়, সেদিকে সতর্ক পরীক্ষাকেন্দ্র মেমারির বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের পরীক্ষকরা। লেখাপড়া শেখার জন্য জগন্নাথের এই কঠিন লড়াইকে তাঁরা রীতিমতো কুর্নিশ জানিয়েছেন।

নুদিপুর ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের শিক্ষকরাও জগন্নাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রধান শিক্ষক কিশোর ঘোষাল বলেন, 'জগন্নাথ খুব ভালো ছেলে। লেখাপড়ার ব্যাপারে ও খুব সচেতন। ওর ব্যবহারে মুগ্ধ স্কুলের সব শিক্ষক থেকে সহপাঠী, সকলেই। কিশোরবাবু আরও বলেন, 'জগন্নাথ আর্থিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে ছোট বয়স থেকেই ওর বৃদ্ধা ঠাকুমা ওকে অনুপ্রাণিত করতেন। সেই প্রেরণায় শত কষ্টের মধ্যেও জগন্নাথ লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুলে পড়াশুনা করার পাশাপাশি সে গ্রামের একজন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে যেত। পায়ে চামচ নিয়ে স্কুলে মিড ডে মিল খাওয়া জগন্নাথ ভালো ফুটবল খেলার পাশাপাশি পা দিয়েই খুব ভালো ছবিও আঁকে।'

publive-image
জগন্নাথ মান্ডি, ছবি- প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে স্কুলে ক্লাস করা ও লেখালেখির জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফে বিশেষ বেঞ্চের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলে সহপাঠীরাও সবসময় জগন্নাথের পাশে থাকে। বেশিরভাগ দিন সহপাঠীরা তাদের সাইকেলে জগন্নাথকে চাপিয়ে নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। প্রধান শিক্ষক জানান, পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জগন্নাথ যাতে অতিরিক্ত সময় পায়, তার জন্য পর্ষদে আবেদন করা হয়েছিল। পর্ষদ তা অনুমোদন করেছে। এই ছাত্র যেরকম মেধাবী, তাতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জগন্নাথ যে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবেই, সে ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিৎ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকরা।

এই ব্যাপারে সিমলা গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ সাঁতরা বলেন, 'জগন্নাথ আমাদের গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রেরণা। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার ক'টা দিন ওকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব আমিই নিয়েছি।' পরীক্ষাকেন্দ্র বাগিলা পূর্ণচন্দ্র স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা অনন্যা তরফদার বলেন, 'পা দিয়ে জগন্নাথ এত সুন্দর করে লিখছে, যা দেখে প্রত্যেকের ভালো লাগছে। পা দিয়ে লেখাও যে এত সুন্দর হয় এবং কেউ পা দিয়ে উত্তরপত্রে গুছিয়ে লিখতে পারে, সেটা জগন্নাথকে দেখেই আমরা জানলাম। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এই ছাত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখে অন্যান্য পড়ুয়ারাও অনুপ্রাণিত হবে।'

আরও পড়ুন- পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে ছোট্ট গ্রাম, উত্তরবঙ্গের এপ্রান্তের অসাধারণ শোভা ভাষায় প্রকাশ কঠিন!

ছাত্র জগন্নাথ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত তার সব পরীক্ষাই ভালো হয়েছে। পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন সে ৪-৫ ঘণ্টা লেখাপড়া করেছে। তাঁর একজন মাত্র প্রাইভেট টিউটর ছিল ঠিকই। কিন্তু, স্কুলের শিক্ষকরাই তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। কষ্ট যাইহোক, আগামী দিনেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় জগন্নাথ। সে জানিয়েছে, তার স্বপ্ন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া। শিক্ষক হয়ে সে তার মত যারা আছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে চায়।

জগন্নাথের ঠাকুমা মুঙ্গলি মান্ডি ও পিসি রিবি মুর্মু বলেন, 'জগন্নাথ লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষের মত মানুষ হোক, এটাই আমরা চাই। ওর মা ওকে ছেড়ে চলে গেলেও আমরা আগামী দিনেও ওর পাশে থাকব। জগন্নাথ একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠলে, আমাদের আদিবাসী মহল্লার ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া শেখায় অনুপ্রাণিত হবে।'

madhyamik exam school student Handicapped youth
Advertisment