শারদীয়ার একমাসের পিঠোপিঠি আরও এক উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজো। জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চন্দননগর, কৃষ্ণনগরের কথা। এর বাইরেও অনেক ঠিকানা আছে, যেখানে শুধু একটি গ্রামেই বাড়ি আর বারোয়ারি মিলিয়ে ২৪-২৫টি পুজো হয়। যেখানে ধান পাহারার টাকায় হয় পুজোর আয়োজন। তেমনই এক সাকিন মুর্শিদাবাদের কাগ্রামের দক্ষিণপাড়ার চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজো।
একজন বাড়ির বউ। আরেকজন তাঁর সৎ মেয়ে, সঙ্গী ননদ। চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে তিন কন্যা মিলে শুরু করলেন জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। যিনি জগতের ধাত্রী হিসেবেই পরিচিত। মুর্শিদাবাদের সালারের কাগ্রামের চট্টোপাধ্য়ায় বাড়ির মাতৃ আরাধনা, নয় নয় করে আজ ১৬০ বছরে।
সিপাহী বিদ্রোহের পর বেশ কয়েক বছর কেটেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রবল দাপটের মধ্যেও নবাবের জেলার সালারের বর্ধিষ্ণু পরিবারের এক বধূর ইচ্ছে ছিল অন্যরকম। সালারের দক্ষিণপাড়ার চট্টোপাধ্যায় বাড়ির সদাপূর্ণা দেবী জগদ্ধাত্রী পুজোর তোড়জোড় শুরু করেন। সঙ্গে পান সৎ মেয়ে বসন্ত কুমারী দেবী ও ননদ ত্রৈলোক্য তারিণী দেবীকে। তিন কন্যার হাত ধরে কাগ্রামের দক্ষিণপাড়ায় শুরু হয় জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। সময়টা ছিল ১৯৬১।
কয়েক বছর পর সাদাপূর্ণা দেবী সংসারের প্রতি কোনও কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। তারপর গৃহত্যাগ, নতুন মোড় ঘুরে যায় জীবনের। অধুনা পূর্ব বর্ধমানের ভান্ডারটিকুরিতে কপিলমুনির শিষ্য়ত্ব গ্রহণ করেন সদাপূর্ণা দেবী। আজও ভান্ডারটিকুরি আশ্রমে ভক্তরা তাঁকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো করেন। সদাপূর্ণা দেবী কপিলমুনির খুব কাছের ছিলেন, তাই গঙ্গাসাগরে মকর সংক্রান্তির পুণ্যস্নানে কপিলমুনির সঙ্গে সদাপূর্ণা দেবীর ছবি স্নান করানো হয়।
আরও পড়ুন অ্যান্টিভাইরাস মণ্ডপ! তাক লাগাচ্ছে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী আরাধনা
বউ ঘর ছেড়ে আশ্রমিক। নিঃসন্তান দুই মহিলার পক্ষে জগদ্ধাত্রী পুজো চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শেষমেষ, বসন্তকুমারী দেবী তাঁর ভাসুরপো শ্রী বিমল চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দেন, পুজো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই সময় বিমল চট্টোপাধ্যায় কাটোয়ায় বসবাস করতেন। পুজোর উদ্দেশে তিনি কাটোয়ার মায়া ত্যাগ করে, মুর্শিদাবাদের কাগ্রামে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন এই দেবী জগদ্ধাত্রীর আকার ছিল খুবই ছোট এবং দেবীর সঙ্গে ছিল মহাসিংহ, বামস্কন্ধে সর্প এবং হস্তি।
পরবর্তীতে বিমল চট্টোপাধ্যায়ের তিন পুত্র এবং তিন কন্যা জন্মানোর পর বসন্তকুমারী দেবী,ভাসুরপোকে নির্দেশ দেন ঠাকুরের কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য। সেইমতো প্রতিমার কাঠামোর পরিবর্তন করা হয়। প্রতিমার আকার বৃদ্ধি করা হয় এবং তার সঙ্গে বশিষ্ঠ ও নারদকে সেই কাঠামোয় স্থাপন করা হয়। বর্তমানে বিমল চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র, পৌত্র এবং প্রপৌত্র নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে চতুর্ভুজার আয়োজন। পুজোর সেদিনের কথা গড়গড় বলে গেলেন চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বর্তমান প্রতিনিধি বিমল চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্র উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়।
দেবী জগদ্ধাত্রীর চারটি হাতে শঙ্খ ,চক্র, তীর এবং ধনুক বিদ্যমান। নবমী তিথিতে তিনটি প্রহরে তিনটি দিনের পূজো একসঙ্গে করা হয়। যথা সাত্ত্বিক অর্থাৎ সকালের পুজো ,রাজসিক অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পুজো ,তামসিক অর্থাৎ অপরাহ্ণের পুজো। পুজোর দিন সর্বপ্রথম শুরু হয় সাত্ত্বিক অর্থাৎ সকালের পূজো। এই পুজোতে মিষ্টি, চালের ভোগ, চিনির ভোগ ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। এরকিছু ক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় রাজসিক অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পুজো। এই পুজোয় দেবীকে নিবেদন করা হয় পুষ্পান্ন, খিচুড়ি- সহনানা ধরনের ব্যঞ্জন। সর্বশেষে শুরু হয় তামসিক অর্থাৎ অপরাহ্ণের পুজো। এই পুজোতে দেবীকে পরমান্ন, নানা ধরনের ফল ও মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয়। এই দিনে দেবীর স্তব পাঠ হয় এবংযজ্ঞ সম্পন্ন হয়।
দেবী জগদ্ধাত্রী পুজো যেহেতু শক্তির পুজো এবং শক্তির পুজোতে বলি দিতে হয় তাই পশু বলি না দিয়ে পাশবিক চরিত্র অর্থাৎ, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য নামক ষড় রিপুর বলি প্রদান করা হয়। বিজয়াতে দেবীকে দধিকর্মা এবং অপরাহ্ণে দেবীকে নানা বাদ্যযন্ত্রের সমারোহে পার্শ্ববর্তী দিঘিতে বিসর্জন করা হয়। মহানবমী ও দশমীতে গমগম করে ওঠে চট্টোপাধ্যায় বাড়ি। গ্রামের সবাইকে নিয়ে মহাপুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন