মঙ্গলবার ভোরে অজয় নদের গোড়ালি ডোবা জল বেড়ে হাঁটু সমান হলো। ফি বছরই জল থাকে না অজয়ে, তাই হিংলো বাঁধ থেকে সরকার পুণ্যস্নানের জন্য জল দেয় এই নদে, তার মাঝে শরীর ডুবিয়ে স্নান করলেন লক্ষ মানুষ। বিরাট লাইন রাধামাধব মন্দিরে পুজো দেওয়ার, গঙ্গাসাগরের সাথে কৌলিন্যে পাল্লা দিচ্ছে বীরভূমের কেন্দুলি মেলা। মেলার কারণে পাঁচদিন মন্দিরের পাশ দিয়ে যান চলাচল স্থগিত।
২ জানুয়ারি বোলপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বাউল উৎসবের সূচনা করেছিলেন, মঙ্গলবার তার আক্ষরিক উদ্বোধন হলো। বাউল সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে কেন্দুলি মেলা তীর্থ যেমন, তেমন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরাও এই মেলাকে পবিত্র ক্ষেত্র বলে মানেন। তিনশতাধিক বছরের পুুরোনো এই মেলায় ভোর রাত থেকে স্নান শুরু করেন পুণ্যার্থীরা, কিন্তু অজয়ের জলস্তর কম থাকায় স্নানের অসুবিধে সকলের, তাই বাঁধ থেকে জল এনে ফেলা হয় অজয়ে, সে জলে স্নান করেন সকলে। বহু বছর ধরেই চলছে এমন রীতি।
রাধামাধব মন্দিরে পুজো দিয়ে বাউল আখড়ায় গানের ভাবাবেগে মাতেন সকলে। এটাই ছিল চেনা ছবি, তবে কয়েক বছর ধরে চেনা ছবি বদলাচ্ছে। বাউলদের সাথে কীর্তনীয়ারা ঢুকে পড়েছেন আসরে। তাঁরাও আখড়া গড়ে ধর্মীয় গানে ভাবাবেগের জোয়ার আনছেন। অজয়ের চরে অসংখ্য আখড়া নির্মিত হয়েছে। শ্রোতা, পুণ্যার্থী, দর্শকের ভিড়ে সেসব আখড়া জমজমাট। কেন্দুলিতে ভোরের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রী, বেলা বাড়ার সঙ্গে তাপ বাড়লেও মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়েনি।
বাউল কীর্তনীয়াদেরও গুণমানের প্রভেদ দেখা যায় মেলায়। যেমন বিখ্যাত শিল্পী সাধন দাস বৈরাগ্য সঙ্গীনী জাপানের বাউলিনী মাকিও কাজুমিকে নিয়ে মেলার এক প্রান্তে যে 'মনের মানুষ' আখড়া গড়েছেন, সেখানে কোন মাইক নেই, নেই হুল্লোড়, দূষণ, চিৎকার। আবিরে রাঙানো মানব বেদীতে সবাই মিলে মানব সমাজের কল্যাণে প্রার্থনা করেন, নির্মল পরিবেশে খড়ের চালাঘরে রাত কাটান ভক্তরা। নিজেদের শৌচালয়, পানীয় জল, রান্নার ব্যবস্থা, সব মিলে এক আধুনিক মনোরম পরিবেশ।
অন্যদিকে বিরাট প্যান্ডেল, মাইক, সাউন্ড বক্সের দাপট অজয়ের বুকে। নানাজনের নামে আশ্রম, সেখানে দুর্গাপুর-বাঁকুড়া কয়লাঞ্চলের দাপট। শৌচের দুর্গন্ধ, ঘুগনি, মুড়ি, কীর্তন, সব অবলীলায় একসাথে চলেছে। তবে তার মধ্যেই বহু গুণী মানুষের আশ্রম আছে, সেখানে খোঁজ নিলে প্রাচীন আয়ুর্বেদের খোঁজ যেমন মেলে, তেমন লুকিয়ে থাকা বা চাপা পড়ে যাওয়া নানা ইতিহাস উঁকি দেয়।
আরো পড়ুন: ভারী গাড়ির ভিড়ে কোণঠাসা কেন্দুলির রাধাবিনোদ
বাউল কীর্তন গানের লড়াই যেমন আছে, তেমন রাজনীতির লড়াইও অবশ্যই আছে অজয়ের বুকে। মুখ্যমন্ত্রী বাউল উৎসবের উদ্বোধন করে বাউল শিল্পীদের ভাতা, অনুষ্ঠানের সুযোগ এসব করে দিয়েছেন, কাজেই বিজেপিও নদীর চর ছাড়তে নারাজ, সোমবার রাত থেকে মেলায় হাজির বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, মঙ্গলবার সকলের মতন নদীতে স্নান করে বললেন, "বীরভূম পাপে ভরে উঠেছে, সবার কেন্দুলিতে পুুুুণ্যস্নান করা উচিত।" দলের নেতা কর্মীরা তাঁকে দিয়ে বইয়ের স্টল উদ্বোধনের আয়োজন করলেও সে পথ মাড়ালেন না দিলীপবাবু।
ওদিকে বীরভূম পাপে ভরছে শুনে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল হুমকি দিলেন, "দিলীপ ঘোষের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে বীরভূমের সব ধর্মীয় স্থান ঘোরালে পাপ কাটবে!" বলা বাহুল্য, মেলায় না থাকলেও আছেন অনুব্রত। যে চার হাজার কীর্তনিয়া দলকে খোল করতাল উপহার দিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই মেলায় এবার আখড়া খুলে বসেছেন। "গান গেয়ে আয় হয়, ভক্তও জুটে যায় অনেক," মন্তব্য এক গ্রামের কীর্তনিয়ার।
কাঁদি ভরা পাকা কলা কাঁধে নিয়ে ঘরে ফেরা, বা মৎসজীবিরা সমস্ত সরঞ্জাম কেনার জন্য এ মেলাকেই বাছেন। তবে সব কিছুর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে 'দেহি পদপল্লবমুদারম'। লক্ষণ সেনের সভাকবি সংস্কৃত পন্ডিত কবি জয়দেব মকর সংক্রান্তির দিনে স্নান করে রাধামাধব মন্দিরে পুজো দিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন অমর সংস্কৃত গীতিকাব্য 'গীতগোবিন্দম'। মেলায় তা নিয়ে কোন আলোচনা নেই, 'গীতগোবিন্দম' এখন বাউল কীর্তনের চীৎকার, মাইকের শব্দ, নানা আওয়াজের মাঝে হারিয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার শেষ হবে জয়দেব কেন্দুলির এই বিখ্যাত মেলা। নির্বিঘ্নে তা শেষ করতে পারাটাই যেন পরীক্ষা বীরভূম জেলা পুলিশের। এসপি শ্যাম সিং নিজে পুরো বাহিনী নিয়ে হাজির। ড্রোন ক্যামেরায় নজরদারি, একাধিক ড্রপ গেট, অসংখ্য পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ার সব যেন উড়ে যাচ্ছে বাঁধভাঙ্গা জনস্রোতের চাপে।