২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির স্লোগান ছিল, 'হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী'। জন্ম থেকে 'হর হর মহাদেব' ধ্বনি শুনে অভ্যস্ত দেশবাসীর অনেকের কানেই স্লোগানটি বেজেছিল। বহু নাগরিকই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাহলে কি নরেন্দ্র মোদীকে ভগবান শিবের সমতুল্য মনে করছেন বিজেপি কর্মীরা? তবে, শুধু মোদীই নন। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও কিছু কম একটা যান না। হয়তো তাঁদের নিয়ে 'হর হর' স্লোগান ওঠেনি। কিন্তু, জনস্বার্থে কিছু করলেই, অথবা নির্বাচন এলেই চোখে পড়ে ওই সব নেতা-নেত্রীদের ছবি দেওয়া পেল্লাই সাইজের কাটআউট। যেন লার্জার দ্যান লাইফ! অথবা সাক্ষাৎ ভগবান।
নিজের সম্পর্কে 'ভগবান' মার্কা কোনও অতিরঞ্জিত শব্দপ্রয়োগে নারাজ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বর্তমানে রাজ্যে নানাবিধ দুর্নীতির মামলা কলকাতা হাইকোর্টে তাঁর এজলাসে চলছে। বিচারপতির আসনে বসে তাঁর একের পর এক কড়া শব্দপ্রয়োগ, ভর্ৎসনা, উপলব্ধি আইনের প্রতি জনমানসের আস্থা বাড়িয়েছে। তাঁর কড়া শাসনে নেতা-মন্ত্রীরাও জেলে গিয়েছেন। জনসাধারণের অনেকে তাঁকে 'বাংলার ভগবান' তকমাও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, সেসবে কান দিতে নারাজ বিচারপতি।
বৃহস্পতিবার তিনি কলকাতা বইমেলায় এসেছিলেন। অন্ধকার নেমেছে। মেলা প্রাঙ্গণের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। তারই মধ্যে রক্ষীদের নিয়ে বইমেলায় প্রবেশ করেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যথারীতি তিনি প্রবেশ করতেই তাঁকে ঘিরে মেলা প্রাঙ্গণে বেশ ভিড় জমে যায়। দর্শক-ক্রেতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। সেসব শুনে এক সাংবাদিক বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন, 'আপনি যখন বইমেলায় ঢুকছেন, তখন সাধারণ মানুষ বলছেন, বাংলার ভগবান এসেছেন।'
জবাবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'না না, ভগবান যদি কেউ থাকেন, যদি কিছু থাকেন, সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষের সংবিধান এবং ভারতবর্ষের আইন। কোনও মানুষ ভগবান নন। ভারতবর্ষে কোনও মানুষ ভগবান নন। ভারতবর্ষে ভগবান যেটা তৈরি করে গিয়েছেন আমাদের গণপরিষদ, সেটা হল ভারতবর্ষের সংবিধান এবং তার অধীনে যে আইনগুলো আছে, সেগুলো। আইন প্রয়োগ করলেই হয়। আপনারা হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে সব অর্ডার পাবেন। সেগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন আমি কী পদ্ধতিতে বিচারটা করি।'
সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, কলকাতার যে নতুন চেহারা তৈরি হয়েছে, কবে এটা মিটবে?' অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জবাবে জানান, এই সম্পর্কে কোনও মন্তব্য তিনি আজকে করবেন না। পরের প্রশ্ন ভেসে আসে, 'দুর্নীতির অদৃশ্য হাত কবে সামনে আসবে? আর কত অপেক্ষা করতে হবে?' জবাবে চুপ করে থাকেন বিচারপতি। ফের পালটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে, 'এটা কি বলা কঠিন স্যার?' জবাবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'না না, বলা কঠিন কিছু না।'
আরও পড়ুন- ‘যত কাদা ছুড়বেন, তত পদ্ম ফুটবে,’ বিরোধীদের কটাক্ষ মোদীর
সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, 'আপনি কি বই লিখবেন?' বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে আছে।' পালটা প্রশ্ন আসে, 'আপনার অভিজ্ঞতার কথা, সেই নিয়ে বই?' জবাবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'সে তো থাকবেই।' উপস্থিত সর্বসাধারণের কৌতূহল নিরসন করে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দেন, বইমেলায় আসাটা তাঁর কাছে নতুন কিছু না। তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই বইমেলায় আসি। বন্ধুবান্ধবরা অনেকে মিলে আসতাম। বইমেলায় না-এলে মনে হয়, একটা পার্বণ মিস করে গেলাম। যেমন, দুর্গাপুজোর দিনগুলোয় না-থাকলে মনে হয়, কলকাতায় ঠিক রইলাম না। সেরকম বইমেলায় না-এলে মনে হয়, কী একটা যেন চলে গেল।'
তাঁর খেদ, বাংলা ভাষার প্রতি নবীন প্রজন্মের আকর্ষণ কমছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'কলকাতা বইমেলায় এত মানুষ আসেন, এত ভালো ভালো বই। বিশেষ করে আমি বলব, ভালো বাংলা বই লেখা হয় এবং প্রকাশ পায়। আমি মনে করি, যারা বাংলা বিমুখ তাঁদের একটু বাংলা বইয়ের দিকে নজর দেওয়া দরকার। বাংলা বইয়ের এত ভালো ভালো টাইটেল আছে, আমি নিজেও সবসময় পড়ি। কিনি, সংগ্রহ করি। সেটাতো করা উচিতই। এখনকার অনেক ছাত্রছাত্রী, তাঁরা বাংলা বিমুখ। বাংলা পড়েন না। কেন পড়েন না, সেটা তাঁদের পরিবারের লোকেরা বলতে পারবেন। আমি মনে করি, অসম্ভব ভালো ভালো বাংলা বই বহুদিন ধরে লেখা হয়ে আসছে। পড়লে যেমন ভালো লাগে, মজা লাগে, আনন্দ পাই।'