একজন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অফিসারকে মামলা থেকে অপসারণ করার আগে তাঁকে 'পোস্ট অফিস' বলা থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় একজন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের (বিডিও) কথিত অসদাচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা, পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসাকে 'লজ্জাজনক' তকমা দেওয়া। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা তাঁর তিক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ এবং কঠোর নির্দেশের জন্য হামেশাই প্রচারের আলোয় উঠে আসেন। তাঁর বিচারপ্রক্রিয়া অনেক সময়ই লাইভ করা হয়। তাঁর পর্যবেক্ষণ, মামলায় কঠোর ভূমিকা এই বিচারপতির অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুতহারে বাড়িয়েছে। ফেসবুকে একটি পেজ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন অনুরাগীরা। সেই পেজের নাম, 'প্রণাম মাননীয় বিচারপতি অমৃতা সিনহা'। ১৯৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর, বিচারপতি সিনহা ২০১৮ সালের ২মে, কলকাতা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার আগে প্রায় দুই দশক ধরে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তিনি অনুশীলন করেছেন। এরপর ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন।
তিনি ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রথমে আলোর বৃত্তে উঠে এসেছিলেন। সেই সময় তিনি ২০২০ সালের মে মাসে আমফান ঘূর্ণিঝড়ের পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেওয়ার জন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের থেকে একদিনের বেতন কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, কর্মচারীদের সম্মতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এটি করতে পারে না। শুনানির সময় বিচারপতি সিনহা বলেন, 'অনুদানের আড়ালে একজন কর্মচারীর বেতন বা তার কোনও অংশ একতরফাভাবে কাটার ক্ষমতা নিয়োগকর্তার নেই। একজন ব্যক্তিকে অনুদান দিতে বাধ্য করা যাবে না। জোর করে নেওয়া হলে, দাতার কাজটি স্বেচ্ছাধীন হয় না। এটি জোর করে কেটে নেওয়ার সমান। যা, 'দান' শব্দের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।' ২০২৩ সালের এপ্রিলে, সুপ্রিম কোর্ট স্কুলের চাকরিতে নিয়োগ কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত দুটি মামলা কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দেয়। একমাস পরে, কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি টিএস শিবগনাম বিচারপতি সিনহাকে মামলাগুলির দায়িত্ব দেন।
পরে, তিনি জুনে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হিংসা সংক্রান্ত মামলার শুনানিও শুরু করেছিলেন। প্রায় ছয় মাস আগে, কলকাতা হাইকোর্টে লাইভ-স্ট্রিমিং শুনানি শুরু হয়। লাইভ করা হবে কি না সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পৃথক বিচারপতিদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যাঁরা লাইভ-স্ট্রিমিং করেছেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি সিনহাও আছেন। তার সঙ্গেই মামলায় বিচারের প্রেক্ষিতে বিচারপতি অমৃতা সিনহার জনপ্রিয়তা শীঘ্রই গগনচুম্বি হয়ে ওঠে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্কুলের চাকরি কেলেঙ্কারির মামলার শুনানির সময়, বিচারপতি সিনহা ইডি অফিসার মিথিলেশ কুমার মিশ্রকে কটাক্ষ করেন। মিথিলেশ কুমার মিশ্র, লোকসভা সাংসদ তথা তৃণমূলের নম্বর-২ অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে তদন্ত করছিলেন। মামলায় অভিষেক ব্যানার্জির সম্পত্তির বিবরণ দিতে গিয়ে জানানো হয়, অভিষেক ব্যানার্জির মাত্র, 'তিনটি বিমা পলিসি আছে। কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই।' যদিও নিয়ম অনুযায়ী, অভিষেক ব্যানার্জির অবশ্যই একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতেই হবে। যেখানে তাঁর বেতন জমা হবে। কারণ, তিনি একজন সাংসদ। কিন্তু, রিপোর্টে তা প্রতিফলিত হয়নি। যার প্রেক্ষিতে বিচারপতি সিনহা ওই ইডি অফিসারকে প্রশ্ন করেন, 'আপনি কী ধরনের রিপোর্ট তৈরি করেছেন? আপনি কি পোস্ট অফিস? কেউ এটি ফরোয়ার্ড করেছেন, নাকি আপনি এটি ছাপিয়েছেন?'
পরবর্তী তারিখে তিনি এই মামলার তদন্তভার থেকে ইডি অফিসার মিথিলেশ কুমার মিশ্রকে সরিয়ে দেন। এমনকী, তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের কোনও মামলার দায়িত্ব না-দেওয়ারও নির্দেশ দেন। বিচারপতি এর পাশাপাশি প্রশ্ন তোলেন, দেশের সেরা তদন্তকারী সংস্থা ইডি এবং সিবিআইয়ের কাছে সম্পত্তির নথি কেন চাইতে হবে? যা কার্যত ওই দুই তদন্তকারী সংস্থার মান নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি, বিচারপতি সিনহা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহের জন্যও ইডিকে নির্দেশ দেন। পুরসভায় চাকরি কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত একটি মামলায়, রাজ্য সরকার সিবিআই এবং ইডি-র নিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করার পরে, বিচারপতি সিনহা বলেছেন, 'কেলেঙ্কারিতে জড়িত রাজ্য সরকারের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক কারাগারের পিছনে রয়েছেন। অপরাধের সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্ত করতে তদন্তকারী সংস্থাগুলি কাজ করছে। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে এগিয়েছে।'
এর আগে একটি মামলায় দুর্গাপূজা কমিটিগুলোকে অনুদান দেওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, 'পেনশন এবং বেতন দেওয়া হচ্ছে না, নিয়োগ করা হচ্ছে না, সবই তো তহবিলের অভাবের কারণেই।' পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় প্রাক-নির্বাচন এবং ভোট-সম্পর্কিত হিংসার সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষেত্রেও বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণগুলো পশ্চিমবঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একটি উদাহরণে, জুনে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে, বিচারপতি সিনহা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, 'যে পরিমাণ হিংসা হয়েছে, তার কারণে নির্বাচন বন্ধ করা উচিত। এটি রাষ্ট্রের পক্ষে লজ্জাজনক।'
পরে, হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া ব্লকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণনায় অনিয়মের এক মামলায়, বিচারপতি সিনহা বিডিও এবং রিটার্নিং অফিসারকে সতর্ক করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'প্রার্থীর উপস্থিতি ছাড়া রিটার্নিং অফিসার কীভাবে গণনা শুরু করতে পারে? কীভাবে ৩১৯টি ব্যালট পুনঃগণনার সময় হঠাৎ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল? এটা কি বাচ্চাদের খেলা? বিডিওর কি চোখ বন্ধ ছিল?'
যদিও বেশ কয়েকজন আইনজীবী বিচারপতি সিনহার মন্তব্যের প্রশংসা করেননি। আইনজীবী বৈশ্বনার চ্যাটার্জি বলেন, 'আমার ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, আদালত যে মতামত দিচ্ছে তা নতুন ব্যাপার। আদালতের সবসময় তদন্তকারী সংস্থার ফলাফল অনুযায়ী রায় দেওয়া উচিত। আদালত নির্দেশ দিতে পারে না। আমাদের সিস্টেমে, প্রত্যেকেরই একটি সীমা আছে এবং কারও তা অতিক্রম করা উচিত নয়।'