বর্গি হানার ইতিহাস আঁকড়ে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে বর্ধমানের ওঁয়াড়ি গ্রামে পূজিতা হচ্ছেন দেবী কালী। নবাবি জমানায় বর্গিরা হানা দিয়েছিল বাংলায়। তছনছ হয়ে গিয়েছিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলার একাংশ। যার রেশ পড়েছিল খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামেও। কথিত আছে প্রায় পাঁচশো বছর আগের সেই বর্গি হামলায় আশ্রয় হারাতে হয়েছিল ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের আরাধ্য দেবী 'বড়মা'কে।
শ্মশান সংলগ্ন পরিত্যক্ত জায়গায় তাঁর ঠাঁই হয়েছিল। দীর্ঘদিন সেখানেই পড়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বপ্নে, দেবী গ্রামেরই বাসিন্দা বুদ্ধদেব সরকারকে নিজের দুরাবস্থার কথা জানান। তার পরই দেবীকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে বুদ্ধদেব সরকার পুজোপাঠ শুরু করেন। পরে মন্দির গড়ে প্রতিষ্ঠা করেন গোটা গ্রামের এই দেবীকে।
সেই থেকে প্রতিবছর কার্তিক অমাবস্যায় কালী পুজোর দিন ওঁয়াড়ি গ্রামে ঘটা করে হয়ে আসছে বড় মায়ের আরাধনা। সাত দিন ধরে পুজো চলে। বর্গিদের মহিষাসুরের সঙ্গে তুলনা করে বড়মায়ের পুজোয় একদা মোষ বলি হত। সেই সময়ে মহিষাসুর বধের উল্লাসে বড়মার প্রতিমার সামনে লাঠি খেলায় মেতে উঠতেন ওঁয়াড়ি গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম যুবকরা। এখন মোষ বলি আর হয় না। বদলে উপাচার মেনে হয় ছাগ, আখ ও ছাঁচি কুমড়ো বলি। তবে আজও প্রথা মেনে কালীমূর্তির সামনে চলে লাঠি খেলা। এই সব নিয়মের বেড়াজালেই দেবী বড়মাকে আঁকড়ে ওঁয়াড়ি গ্রামে টিকে রয়েছে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন।
এখানে দেবী কালী রূপে পূজিতা হলেও আদতে তিনি দুর্গা ও কালী উভয় রূপিণী। তাঁর সঙ্গে রয়েছে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। সঙ্গে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, বড়মার কাছে কেউ কিছু চাইলে তিনি তাঁকে নিরাশ করেন না। পূর্বে সরকার বাড়িতেই দেবী পূজিতা হতেন। এখন তিনি ওঁয়াড়ি গ্রামের সর্বসাধারণের দেবী।
আরও পড়ুন- সৃষ্টি হল ইতিহাস, ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক
বিশাল মন্দির। ৩০-৩৫ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে দেবীর নামে। সেই জমির আয় থেকেই সারা বছর বড় মায়ের নিত্যসেবা ও কার্তিক অমাবস্যা তিথির বিশেষ পুজোপাঠ হয়। পুজারী তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, তন্ত্র মতেই হয় পুজো। ভোগে থাকে চালকলাই ভাজা ও চিনি। কালীপুজোর রাত থেকে শুরু করে সাত দিন চলে বিশেষ পুজোপাঠ। বছরের অন্য দিনগুলোয় গ্রামের বাসিন্দারা কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর সাতটি দিন সবাই গ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় উৎসবমুখর থাকে ওঁয়াড়ি। এলাকায় বসে বিশাল মেলা। চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালা।
দেবী বড়মার রূপ ও মাহাত্ম্য নিয়ে ওঁয়াড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে বহু কাহিনি প্রচলিত আছে। স্থানীয় বাসিন্দা মধুসূদন চন্দ্র বলেন, 'শোনা যায় গ্রামের সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষ বুদ্ধদেব সরকার খুব গরিব ছিলেন। উদাস মনের কালীভক্ত মানুষটি ওঁয়াড়ির শ্মশানঘাটের কাছে পোষা গরু চরাতে যেতেন। একদিন সেখানেই ঘুমিয়ে যান। স্বপ্নে বড়মা তাঁকে দর্শন দেয়। বড়মার নির্দেশ মেনেই বুদ্ধদেব তাঁর পুজো শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাঁর অবস্থা ফেরে।'