Advertisment

দেবীর স্বপ্নাদেশে পুজো শুরু, কাঁথির কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় মস্ত ইতিহাস

৩০০ বছরের ওবেসি সময় ধরে কাঁথির এই রাজবাড়িতে দেবী মহামায়ার আরাধনা হয়ে চলেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kanthi kishore nagar garh rajbari durgapuja

ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানায় ভরপুর এই পুজো এতল্লাটে বেশ জনপ্রিয়। ছবি: কৌশিক দাস।

অতিমারির প্রকোপ কাটিয়ে আবারও ছন্দে ফিরেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। আর এই পুজোর প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে আসে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা। ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানায় বনেদী বাড়ির দুর্গাপুজো ক্লাব বা সর্বজনীন পুজোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বনেদি জমিদার বা রাজবাড়ি। প্রতিটি বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোয় জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। সেই ইতিহাস কিছুটা লৌকিক আবার কিছুটা অলৌকিক কাহিনী মিশ্রিত। কালের নিয়মে বনেদী বাড়ির দুর্গাপজোয় জৌলুস কমলেও, ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানা এখনও অটুট।

Advertisment

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথির প্রাচীন বনেদি বাড়ির পুজো কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। তিন শতাব্দীর ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে আজও সমান মর্যাদায় পূজিত হয় এই রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা। কালের নিয়মে কমেছে জৌলুস। কিন্তু আজও কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে ভিড় জমায় এলাকাবাসীরা। কথিত আছে এই রাজপরিবারের পূর্বপুরুষ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। যার আজ বর্তমান বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। প্রাচীন এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে মায়ের ঘট পশ্চিমমুখী। পরিবারের বর্তমান এক সদস্য বলেন, "প্রায় ১৭২০ সালে প্রথম এই পুজো শুরু হয়। স্বর্গীয় রাজা যাদবরাম রায় দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশে পুজো শুরু করেন। বর্তমানে পুজোর বয়স প্রায় ৩০০ বছরের বেশি।"

publive-image
রাজবাড়িতে চলছে ঠাকুর গড়ার কাজ।

পুজোতে একসময় বলি প্রথা প্রচলন ছিল। প্রতি বছর মহিষ বলি দেওয়া হত। মহিষ বলি চালু ছিল প্রায় ২৬৫ বছরের বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত মহিষ মারা গেলে বন্ধ হয়ে যায় পশু বলি প্রথা। ১৯৮৫ সালের বন্যায় রাজবাড়ীর গোশালা ভেঙে পড়ে। গোশালায় দেবীর উৎসর্গীকৃত মহিষ দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। সে বছর থেকেই পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। পশু বলির পরিবর্তে আঁখ ও চাল কুমড়ো বলি শুরু হয় সেই বছর থেকে। এখনও আঁখ চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হয় রীতি মেনে।

publive-image
কাঁথির কিশোর নগর গড় রাজবাড়ি।

কাঁথি শহরের কিশোর নগর গড় রাজবাড়ীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মা এখানে পূজিত হয় পশ্চিমমুখী ঘটে। পশ্চিম মুখী ঘটে দেবী দুর্গার আরাধনা বাংলা আর কোথাও হয় না। প্রাচীন এই দুর্গাপুজোর পরিবারের পশ্চিম মুখী ঘটে দেবী আরাধনার পিছনে আছে চমকপ্রদ কাহিনী। এই রাজপরিবারের সদস্য, দেবীর পূজার শুরু থেকে পশ্চিমমুখী ঘট স্থাপন হত না। পশ্চিমবঙ্গে ঘট স্থাপন হয় পুজো শুরু হওয়ার আরও কুড়ি-পঁচিশ বছর পর। শোনা যায়, পুজোর চার দিন দেবী মায়ের আরাধনা পাশাপাশি। দেবী বন্দনা গান। বলতো ব্রাহ্মণ ও উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষেরা পুজোর চারদিন দেবী বন্দনা গান করত। একবার এক জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ এসে সেই সময়ের রাজাকে বলে সে এবছর দেবী বন্দনা গান গাইবে।

সেই জেলে আরও বলে তিনি দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই দেবী বন্দনা গান করতে এসেছেন। কিন্তু জেলে ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায়, রাজপরিবারের কেউ রাজি ছিল না। ওই জেলে ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষটি ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যায়। সেবছর দুর্গা মায়ের আরাধনার সময় মায়ের মন্দিরের পিছনে বসে দেবী বন্দনা গান করেন। গান শুরু হলে দেখা যায় মায়ের পুজোর ঘট আপনা থেকেই মন্দিরের পিছন দিকে ঘুরে গেছে এবং তা পশ্চিমমুখী।" সেই থেকে পশ্চিমমুখী ঘটে দেবী আরাধনা আজও হয়ে আসছে কাঁথির কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয়।

আরও পড়ুন- ফের আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা! মহালয়ায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস ৫ জেলায়

প্রতিটি বনেদি পরিবারের প্রাচীন দুর্গাপূজার বিশেষ রীতিনীতি আছে। ভোগ প্রসাদের কিছু রীতিনীতি আছে। কিশোর নগর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন ঘটোত্তলনের মধ্য দিয়ে। নিয়ম মেনেই মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী সন্ধিপুজো, মহানবমী এবং দশমীর পুজো ও বিসর্জন হয়। মহাষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেওয়ার জন্য মানুষজন ভিড় করে আসে এই রাজ বাড়ীর দালানে। নিয়ম মেনেই সন্ধিপুজো হয় একশোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে। প্রদীপের সলতে তৈরীর কাজে হাত লাগান রাজপরিবারের মহিলারা। কাঁথি কিশোর নগর রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় যজ্ঞের হোমে সরাসরি অগ্নিসংযোগ করা হয় না। সূর্যের রশ্মিকে দর্পণের মাধ্যমে ফেলে হোমে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

আরও পড়ুন- ভোগান্তির ১০০ ঘণ্টা, বাতিল আড়াইশোর বেশি ট্রেন, কুড়মি-বিক্ষোভে মাত্রাছাড়া দুর্ভোগ

একসময় ঘটোত্তলনের সময় কামান দাগা হতো। পুজোয় দেবী মা কে অন্নভোগ ফল মিষ্টান্ন ভোগ নিবেদনের পাশাপাশি কাজু বাদাম দিয়ে হাতে তৈরি এক প্রকার সন্দেশ ভোগ দেওয়া হয়। এই কাজু বাদাম দিয়ে সন্দেশ ভোগ কাঁথির আর কোন পুজোতে দেওয়া হয় না। এই সন্দেশ ভোগ প্রসাদ লাভের জন্য মানুষের ভিড় পড়ে। বর্তমানে এই বিশেষ ভোগের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রাচীন বনেদি বাড়ি বা রাজপরিবারের পুজো মানেই পরিবারের মিলন উৎসব। পুজোর ক'টা দিন বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় সদস্যদের মধ্যে জমিয়ে আড্ডাতে মেতে পরিবারের সদস্যরা।

Durgapuja West Bengal pujo
Advertisment