Advertisment

ভিন রাজ্যে স্বপ্নসন্ধানের বাহন, কর্মভূমি এক্সপ্রেস

"গ্রামের ছেলেমেয়েরা কমবেশি সবাই লেখাপড়া শিখছে। নিজের এলাকায় নির্মাণ বা মাটি কাটার কাজ করতে সম্মানে লাগে, দূর দেশে গিয়ে সেসব কাজে কোন লজ্জাশরম থাকে না। আর ব্যবসা করে কেউ নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইলে, পুঁজিটা দেবে কে?"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

স্বপ্নের গাড়ি

রবিবারের সকালে এত মানুষের ভীড় দেখে অবাক হতে হয়। বীরভূমের রামপুরহাট স্টেশন হোক বা বোলপুর, ছবিটা এক - বিরাট ব্যাগ-বস্তা, জলের জায়গা, আর পরিবারের সদস্যদের হাত ধরে থাকা কমবয়সীদের জলে ভেজা চোখ।

Advertisment

বাড়ির ছেলে চলেছে কাজের খোঁজে। কর্মভূমি এক্সপ্রেস ধরে সোজা মুম্বই, সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে ওপরওয়ালা জানেন। দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জের তরতাজা জোয়ান ঝকঝকে মুখের ছেলেগুলো জড়িয়ে থাকে মাকে-স্ত্রীকে, সন্তানদের আঁকড়ে ধরে থাকে। অবশেষে ঢোকে কর্মভূমি এক্সপ্রেস। ভীড় উপচে পড়া ট্রেনে মালপত্র নিয়ে কসরৎ করে ভেতরে ঢোকে ছেলেটা। বাইরে থেকে পরিবার জানলা দিয়ে হাত নাড়ে, তাতে কত না বলা কথা ভেসে আসে। "ফোন করিস বাপ," "দুবেলা খেয়ো," "উঁচু মাচায় ঝুলে কাজ কোরো না।" কোলের শিশু কিছু না বুঝে কান্না জুড়ে দেয়। ট্রেন চলতে শুরু করে।

কর্মভূমি এক্সপ্রেস। আসামের কামাক্ষ্যা থেকে মুম্বইয়ের লোকমান্য তিলক টার্মিনাস পর্যন্ত চলা সুপারফাস্ট ট্রেন। এ অঞ্চলের যুবকদের ভাগ্যান্বেষণের চাবিকাঠি। কে জানত, ট্রেনের নামের সঙ্গে তার সওয়ারিদের মনোবাসনার এমন আশ্চর্য মিল হবে?

আরও পড়ুন: খুলে গেছে রামপুরহাট-জসিডি রেলপথ, আবার নাগালের মধ্যে বাঙালীর ঐতিহ্যময় ‘পশ্চিম’

publive-image এভাবেই প্রাণপাত করে সফর

পুজো যায়, ঈদ যায়, কত পরব চলে যায়, বাড়ির ছেলে রোজগার করে ফেরে কয়েক বছর পরে, এটাই চেনা ছবি হয়ে গেছে এলাকার মানুষদের কাছে। স্টেশনের রিজার্ভেশন কাউন্টারে বসা কর্মী ট্রেনের নম্বর দেখেই বলে দেন, "ওয়েটিং লিস্ট একশোর বেশি, তৎকালে কাটো নাহলে এসি-তে।" তাও কিছুসময় পর অমিল। বারোমাস এক ছবি, দুটো মাত্র সাধারণ কোচ আর কয়েকটা স্লিপার, কোথাও আসন মেলে না। বাধ্য হয়ে অনেকে এসি-তেও সংরক্ষণ করান। লাভজনক ট্রেনটার তাই এখন কোচ বদলেছে, এক্সপ্রেস থেকে সুপারফাস্ট হয়েছে কর্মভূমি। এখন লোকমান্য তিলকের বদলে কল্যাণ পর্যন্ত চলে। ট্রেনে কর্তব্যরত রেলকর্মীর কথায়, "কী অবস্থায় যে মানুষগুলো যান, না দেখলে বুঝতে পারবেন না।" ট্রেনের শৌচালয়ের সামনে যতটুকু জায়গা, সেখানে তিনজন মিলে শুয়ে ২০০০ কিলোমিটারের বেশি পাড়ি দেন।

কেন এত ভীড়? মুম্বই যাওয়ার তো অসংখ্য ট্রেন আছে, তবু যত ভীড় এই ট্রেনে কেন? মুর্শিদাবাদ নবগ্রামের বাসিন্দা সফিউল ইসলাম বলেন, "এই ট্রেনটায় যারা যায় তাদের প্রায় সবাই কাজ করতে প্রথমে মুম্বই যায়। কোনও কাজের আগাম খবরও থাকে না, অনেকসময় ট্রেনের পাশে বসা সঙ্গী বলে দেয় কোথায় কেমন মজুরি চলছে, সেখানে কাজের ধরন পছন্দ হলে সেই সঙ্গী মারফৎ সেখানে যাওয়া, নয়তো ট্রেন থেকে নেমে বাংলাভাষি শ্রমিকদের ডেরায় একবার হাজিরা দিলেই হলো। কেউ খালি হাতে ঘোরে না।"

ট্রেনটার এ রাজ্যে চলার পথটাও কর্মপ্রার্থী মানুষদের কাছে ভরসার। বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকরা হাসিমারা বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে উঠছেন, মালদহ-মুর্শিদাবাদের দক্ষ নির্মাণ কর্মীরা মালদহে চড়ছেন, বীরভূম-বর্ধমানের দিনমজুররা ট্রেনটা পাচ্ছেন তাঁদের বাড়ির কাছে। তেমনি হাওড়া-মেদিনীপুরের সোনার কারিগর, জরিশিল্পী, সবাই কর্মভূমি এক্সপ্রেসের সওয়ার। ট্রেনের নাম মাহাত্ম্য হয়তো এই আকর্ষনের বড় কারণ। বাংলার যৌবনের ঢল চলে মুম্বইয়ে গতর খাটিয়ে খাওয়ার প্রত্যাশায়।

নাগরাকাটার সনজু ওরাওঁ, গাজলের স্বপন দাস, তকিপুরের শামসুদ্দিনের আলাপ ট্রেনেই। সবাই চলেছেন কাজের খোঁজে, এর মধ্যে স্বপন আগে মুম্বইতে কাজ করেছেন, পারিবারিক কারণে বাড়ি ফিরে আবার রোজগারের আশায় চলেছেন। খোলাখুলি বলেন, "আগেও আমরা মুম্বইতে কাজ করতাম, ওখানে মজুরি তিন-চারগুণ বেশি এখন এখানকার চেয়ে। কাজের জন্য ওখানে ভীড় বাড়ছে। কলেজ পাশ ছেলেরাও কাজ খুঁজতে ওখানে চলে আসছে।

আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে মুখ উজ্জ্বল বাংলার, শালবনির কৃষকের পায়ে পায়ে

"কেউ আবার বেশি টাকার জন্য কেরালা-বেঙ্গালুরু-হায়দ্রাবাদ-সুরাট-চেন্নাই চলে যাচ্ছেন। মুম্বই থেকে সব জায়গায় যাতায়াতের ট্রেন আছে। রাজমিস্ত্রি থেকে সোনার কারিগর, বাঙালিদের এখনও কদর আছে ওখানে, এখন কেরালার নারকেল তেলের কারখানায় কাজ যেমন বেড়েছে, তেমন পুণেতে দিনমজুরির কাজেও মজুরি আরও অনেক বেশি। এখানে কাজ কোথায়? আগে তো একশো দিনের কাজ ছিল, তা নিয়ে যা সব মারামারি রাজনীতি, ওসব আর পোষায় না।"

কিন্তু নিজের এলাকা ঘরবাড়ি ছেড়ে এতদূরে থাকতে সমস্যা হয় না? শামসুদ্দিনের জবাব, "মন তো খারাপ করে, কিন্তু পেটের দায়, কি করব?" স্বপন জানালেন, "বছর কুড়ি আগেও দিল্লীতে কাজের জন্য ভীড় হতো খুব, কিন্তু ওখানে সব বাংলাদেশি মনে করে মাঝেমাঝে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, আরও সব সমস্যা বাড়ছিল, তাই অনেকেই দিল্লী ছেড়েছি। আর যদি ঠিকঠাক কাজ করে টাকা জমাতে পারি, তবে ইচ্ছে আছে গ্রামে ফিরে হয় একটা মুদির দোকান দেব, নাহলে ট্র্যাক্টর কিনে চালাব। সরকার আমাদের তো কোন ব্যাঙ্ক লোনও দেবে না!

publive-image আপাতত গন্তব্য মুম্বই

"একটা জিনিস হলো, গ্রামের ছেলেমেয়েরা কমবেশি সবাই কিন্তু লেখাপড়া শিখছে। নিজের এলাকায় নির্মাণকর্মী বা মাটি কাটার কাজ করতে তো সম্মানে লাগে, এবার দূর দেশে গিয়ে সেসব কাজে কোন লজ্জাশরমও থাকে না। আর যদি ব্যবসা করে কেউ নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, সেই ব্যবসার পুঁজিটা দেবে কে? ব্যাঙ্ক লোন তো আমরা পাব না, বন্ধক রাখার মতোও কিছু নেই। তাহলে খাবে কী করে গরিব মানুষ?" তাঁর আরও বক্তব্য, "চা বাগানের বহু শ্রমিক গত তিন বছরে এসেছেন শুধু বিল্ডিঙে যোগান দেওয়ার কাজ করতে, সংখ্যায় এখন তাঁরা কয়েক হাজার হয়ে গেছেন। প্রতিটা কর্মভূমিতেই চা বাগানের শ্রমিকরা বিরাট সংখ্যায় আসছেন কাজ করতে।" সনজুকে দেখিয়ে বলেন, "আজ ও চলল, সঙ্গে আরও বত্রিশজন বন্ধু শুধু ওরই।"

আরও পড়ুন: ইটভাটা চলছে ডুয়ার্সের বনাঞ্চলে, অন্ধকারে প্রশাসন

১৬ থেকে ৫০ বছরের চেহারাগুলো কাজের খোঁজে আয়ের আশায় পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে, কিন্তু চোখে মুখে আনন্দের লেশ নেই। কেউ কানে হেডফোন গুঁজে আছেন, কেউ মুখ গুঁজে কাঁদছেন, কেউ চুপচাপ। রবিউল বলেন, "ঘর ছেড়ে সব চলেছে তো, মন কি খারাপ হয় না? বাড়ির মানুষজনও ভাবছে, এরাও ভাবছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।"

সাধারণ কোচে যদি মেঝেতেও বসার আসন না জোটে, অনেকে চেষ্টা করেন সংরক্ষিত কোচের টয়লেটের সামনেটা দখল করতে, কিন্তু টিকিট চেকার বা পুলিশকে বাগে আনাই কঠিন হয়ে পড়ে, যতক্ষণ না তাঁদেরই মতন যাত্রীরা সবদিক ম্যানেজ করে নিজেদের আসনে ডেকে নেন। একটা ভারি মজার বিষয় হলো, এই ট্রেনে কোন যাত্রী কোন উদ্দেশ্যে চলেছেন, দু-একবার এই ট্রেনের পুরোনো সওয়াররা দেখেই বলে দেন। পারস্পরিক সহানুভূতি হয়তো যন্ত্রণা আর অভিমানের মাঝেই জন্মে যায়।

যৌবন হতাশ হয়ে রাজ্য ছাড়ছে। যে মেধা, যে শ্রমে আরও সমৃদ্ধ হতে পারত পশ্চিমবঙ্গ, তার সুফল পাচ্ছে অন্য রাজ্য। আসাম থেকে ছাড়া ট্রেনটা যেন তাচ্ছিল্য করেই এগিয়ে চলে, শুধু সেই পুরনো প্রশ্নটা উসকে দেয়, আমাদের জন্মভূমি কবে হবে আমাদের কর্মভূমি?

government of west bengal Assam
Advertisment