গত সপ্তাহে বীরভূমের ইলামবাজারে সরকারী সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাউল উৎসবের উদ্বোধন করলেন । শতাধিক বাউল শিল্পী একসাথে গাইলেন, মুখ্যমন্ত্রী সুর মেলালেন। বাউল শিল্পীদের সরকারী ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি সরকারী অনুষ্ঠান বা প্রচারের সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষনাও তিনি করলেন। এ পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়, একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।
আগামী ১৫ জানুয়ারি, মকর সংক্রান্তির দিন, বাউলরা কেন্দুলি গ্রামে অজয় নদীতে স্নান করে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী রাধাবিনোদ মন্দিরে পুজো দিয়ে রাতভর বাউল গানে মাতেন, রাজ্যের সমস্ত প্রান্তের বাউল শিল্পীরা মকর সংক্রান্তিতে কেন্দুলিতে আসেন, এটাই তাঁদের দীর্ঘকালের রীতি। কিন্তু বাউলদের কেন্দুলি গ্রামের কেন্দ্রবিন্দু রাধাবিনোদ মন্দিরই যে বিপদের মুখে, এই কঠিন সত্যিটা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রী পুজো দেবেন, সরলেন মা তারা
১৬৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুর পোড়ামাটি বা টেরাকোটার এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের টেরাকোটায় রামায়ণের নানা কাহিনী ছাড়াও নানা দুর্লভ প্রাচীন কাহিনী খোদিত ছিল। এখন মন্দিরটির রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ, কিন্তু সেই মন্দিরের এমন দশা যে মন্দিরের পুজারী বেনীমাধব অধিকারী বলছেন, "মন্দিরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি, মন্দিরের গা ঘেঁষে ভারী ট্রাক, বাস, ট্রাক্টর ছুটছে, মন্দির কাঁপছে। খসে পড়ছে টেরাকোটার টুকরো, ধুলোয় ভর্তি চারদিক।"
একটি পুরাতাত্ত্বিক সম্পদের গা ঘেঁষে এমন রাজপথ কেন? স্থানীয় মানুষ বলছেন, কয়েক মাস হলো এই "অত্যাচার" শুরু হয়েছে। আগে যা ছিল গ্রামের পথ, এখন নেতাদের দৌলতে তাই জয়দেব রোড। কিন্তু হঠাৎ এই পথটিই কেন? জেলা প্রশাসনের যে প্রতিনিধির কাছেই জানতে চাওয়া হয়, তিনিই সযত্নে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
পানাগড় মোরগ্রাম হাইওয়েতে সমস্ত গাড়ি ইলামবাজারের ওপর অজয় সেতু হয়ে চলাচল করত, কিন্তু অজয় সেতুর ওপর টোল ট্যাক্স সংগ্রহের অধিকার ই-টেন্ডার মারফত যিনি পেয়েছেন, তিনি বিরোধী শিবিরের আগমার্কা নেতা, শাসকদলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। বহু আইনি পদক্ষেপ নিয়ে, সরকারি তরফে টোল ট্যাক্স সংগ্রহ কেন্দ্রের মালিক হয়েও তিনি ট্যাক্স দেবে এমন গাড়ি প্রায় পাচ্ছেন না, অথচ জয়দেব মোড়ের কাছে দেখা গেল, লাঠি হাতে কয়েকজন যুবক সমস্ত গাড়ি মূল পথ থেকে সরিয়ে মাঝপথে জয়দেব কেন্দুলি গ্রামের পাশ দিয়ে অজয় নদীর ওপর দিয়ে চলাচলের নির্দেশ দিচ্ছেন। কেন্দুলিতে অজয় নদীতে নামার মুখে অস্থায়ী টোল ট্যাক্স বুথ, গাড়ি পিছু ১০০ টাকা করে নিচ্ছেন বুথ কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, পঞ্চায়েত সমিতি অনুমোদিত এই টোল ট্যাক্স বুথ, চালাচ্ছেন স্থানীয়রাই।
রাজনীতি বা টোল ট্যাক্সের লাভক্ষতি থাক তার জায়গায়, কিন্তু দেশের ঐতিহ্যবাহী কেন্দুলি মন্দির তো আগে বাঁচুক, এই আর্তি স্থানীয় সমস্ত মানুষের। প্রয়োজনে নিজেরাই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এ বিষয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ চাইতে রাজি এলাকাবাসীরা।
প্রায় ৩৫০ বছর আগে কবি জয়দেব এ মন্দিরের অলিন্দে কদমখন্ডী ঘাটে বসে লিখেছিলেন, 'দেহি পদপল্লবমুদারম'। সৃষ্টির সেই প্রাণকেন্দ্রকে যে এমন বিপন্ন করে তুলবেন কিছু মানুষ, তা ভাবতে পারেন নি কেউ।