রবিন বিশ্বাস। বয়স ২৮। বাড়ি বসিরহাটে। শিশুসন্তানের দুরারোগ্য হৃদযন্ত্রের অসুখ সারাতে কয়েকদিন যাবত পড়ে রয়েছেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের চত্বরে। অনেক ঘাম ঝরানোর পর ছেলেকে ভর্তি করতে পেরেছেন বটে, কিন্তু তাঁর 'নার্সিং' করবেন কে? রাতটুকু না হয় রাস্তাতেই কাটাবেন, কিন্তু খাওয়াদাওয়া! কলকাতা শহরে তিন বেলা খেতে খুব কম করেও প্রায় ১০০ টাকা খরচ। ডাক্তার জানিয়েছেন, অন্তত দিন পনেরো থাকতেই হবে। অর্থাৎ প্রায় ১৫০০ টাকার ধাক্কা। হতদরিদ্র খেতমজুর পাবেন কোথায় এত অর্থ!
রবিনের সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়তো হয়নি, কিন্তু সুরাহা হয়েছে অনেকটাই। রাতের খাবারের চিন্তা মিটেছে। প্রতিদিন রাতে তাঁর হাতে খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে যান এক ব্যক্তি। সেই খাবারের খানিকটা থেকে যায় পরদিন সকালের জন্যেও।
আরও পড়ুন, পকেটের টাকা দিয়ে প্রতিদিন ছাত্রীদের মিড-ডে মিল খাওয়ান এই কলেজের অধ্যাপিকারা
রবিনের যিনি অসময়ের অন্নদাতা, তিনি পেশায় পুলকার চালক। প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেন, নিয়ে আসেন। কিন্তু সেই তিনিই সূর্য ডোবার পর পাল্টে যান। নিজের গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যান একের পর এক সরকারি হাসপাতালে। সেখানে অপেক্ষারত রোগীর আত্মীয়স্বজনদের হাতে তুলে দেন খাবারের প্যাকেট। প্রতিদিন, নিয়ম করে। ঝড়, জল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উৎসব- যা-ই হোক না কেন, দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা পার্থ চৌধুরীর কাজে কামাই নেই। তাঁর পাশে থাকেন কয়েকজন ডাক্তারি পড়ুয়াও।
কেন এমন উদ্যোগ? দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা পার্থবাবু জানান, তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ওই সংস্থা শহরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁর বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে তা কলকাতার বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথবাসীদের মধ্যে বিলি করত।
আরও পড়ুন, গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষত সারিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন বিলকিস
পার্থ বলেন, "আমরা সাধারণত দরিদ্র মানুষদের মধ্যেই খাবার বিলি করতাম। তারপর একদিন মনে হল, সরকারি হাসপাতালগুলিতে রাতভর এমন অনেক মানুষ থাকেন, যাঁদের খাওয়া জোটে না। এঁদের মধ্যে কেউ নিজেই রোগী, একটা সিট পাওয়ার আশায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। কেউ আবার রোগীর আত্মীয়। কোনওরকমে প্রিয়জনকে হয়তো ভর্তি করতে পেরেছেন, কিন্তু প্রতিদিন রাত জাগতে হচ্ছে হাসপাতাল চত্বরে। এঁদের অধিকাংশই কলকাতার বাসিন্দা নন, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষ। বেশিরভাগেরই আর্থিক সঙ্গতিও নেই। চিকিৎসার যাবতীয় ঝক্কি সামলে অনেকেই ঠিক মতো খাবার জোটাতে পারেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আর কিছু না পারি, প্রতিদিন রাতে এঁদের মুখে কিছুটা খাবার তুলে দেব।"
প্রতিদিন সন্ধে হতেই শহরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁ থেকে খাবার সংগ্রহ করেন পার্থ। তারপর গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যান শহরের চারটি নামজাদা সরকারি হাসপাতালে। এস এস কে এম, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, বাঙুর এবং চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে পার্থদের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন রোগীর পরিজনেরা। শুভম লোধা, বল্লরী গুপ্ত, আকাশ পাঠকের মতো ডাক্তারি পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে তাঁদের হাতে খাবার তুলে দেন পার্থ। তাঁর কথায়, প্রতিদিন গড়ে ১৭৫ জন মানুষের কাছে আমরা পৌঁছতে পারছি। আগামী কয়েক মাসে এই সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়াতে পারব বলে আশাবাদী।
পার্থরা সাধারণত হাসপাতাল চত্বরে পৌঁছে যান রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। তার প্রায় ঘন্টাখানেক আগেই লাইন দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেন রোগীর পরিজনেরা। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা সাবিনা ইয়াসমিন স্বামীর চিকিৎসার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন এস এস কে এম চত্বরে। তাঁর কথায়, "আমরা বিড়ি বেঁধে পেট চালাই। দিন আনি, দিন খাই। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ লাগে না ঠিকই, কিন্তু কলকাতায় সাতদিন থাকব যে তার উপায় কই! রাস্তায়, ফুটপাথে, হাসপাতাল চত্বরে শুয়ে পড়ি, খরচ লাগে না। কিন্তু তিন বেলা দোকানে খাওয়ার সামর্থ্য তো নেই আমাদের মতো মানুষের। এঁরা একবেলা খাবার দেন, তাতে বেশ কিছুটা সুবিধা হয়।"
পার্থদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের মানুষজন। স্বাস্থ্য আন্দোলনের সংগঠক রেজাউল করিম বলেন, "অত্যন্ত সাধুবাদযোগ্য উদ্যোগ। চিকিৎসার খরচ মুকুব হলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না, এই ধরনের নাগরিক উদ্যোগ প্রয়োজন।"