(কলকাতা তথা পশ্চিম বাংলার কিছু ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত ও ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব স্বল্প-জানা কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।)
শক হুণ পাঠান মোগল যে এদেশের বুকে লীন হয়েছিল, সে নতুন কথা নয়। তাছাড়াও ইওরোপের নানা দেশ থেকে নানা জাতি নানা সময়ে বসতি ও বেসাতি শুরু করেছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। দুশো বছরের শাসক ইংরেজদের বাদ দিলেও গোয়ায় পর্তুগিজ, শ্রীরামপুরে ড্যানিশ, পণ্ডিচেরি-চন্দননগরে ফরাসী, চুঁচুড়ায় ডাচরা তাদের উপনিবেশের বেশ কিছু ছাপ রেখে গেছে স্থাপত্যে। কিন্তু সরাসরি স্কটিশ নিদর্শন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তারাও এসেছিল। প্রধানত ইংরেজদের হয়ে কাজ করতে। কলকাতায় রয়েছে স্কটিশ চার্চ স্কুল ও কলেজ, স্থাপন করেছিলেন স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতায় ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তিনি।
ব্রিটিশরা ভারতে রাজ্যপাট স্থাপনের সঙ্গেসঙ্গেই তাদের নানা সরকারি কাজে, সেনাবাহিনীর নানা পদে, ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়িক বিস্তারের সূত্রে বহু স্কটিশের আগমন ঘটে এদেশে, বিশেষত কলকাতায়। তাদের জন্য চার্চও তৈরি হয়। ডালহৌসি অঞ্চলের সেন্ট অ্যানড্রুজ চার্চ সেই স্কটিশ চার্চ। আর এই চার্চের অধীনস্থ স্কটিশদের জন্য পৃথক কবরখানা তৈরি হয় ১৮২০ সালে।
আরও পড়ুন, কলকাতায় মহীশূরের বাঘ
সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারিকে ডান দিকে ছেড়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডে পড়লে উল্টো দিকে ঢুকে গেছে কড়েয়া রোড। ব্রিটিশ আমলে এখানে ছিল সুবিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লী। আর এখন ব্যস্ত রাস্তা, গ্যারাজ, গাড়ির সারির মধ্যে উঁচু পাঁচিল ঘেরা এক মরুদ্যানের মত শুয়ে আছে স্কটিশ সিমেটারি। গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রায় ছয় একর জায়গা জুড়ে অযত্নলালিত সবুজ ঘাসের জঙ্গলে মাথা তুলে আছে অজস্র কবরের ফলক। কান পাতলে শোনা যায় সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে আসা কবেকার মৃত মানুষদের ইতিহাস। জানা যায় কোন কবরের ওপরের মার্বেল বা গ্রানাইট সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল। চৌকো প্ল্যানের জমিটুকু যেন স্থাপত্যে ভাস্কর্যে স্কটল্যান্ডের এক টুকরো।
এক সময়ে গ্রিড পদ্ধতিতে কবরগুলো খোঁড়া হয়েছিল। ১৯৪০-এর পর থেকে কবরখানাটি আর ব্যবহৃত হয়নি। স্বাধীনতার পর থকে আরো বেশি অবহেলিত হয়ে আগাছার জঙ্গলে ঢেকে পড়েছিল এটি। সম্প্রতি ২০০৮ সালে কলকাতা স্কটিশ হেরিটেজ ট্রাস্ট (KSHT) স্কটল্যান্ড ও ভারতের যোগাযোগসুত্র খোঁজার চেষ্টা শুরু করে এবং এই কবরখানাটির সংস্কার, সমাধিগুলির নাম ও ইতিহাস পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়। উঠে আসে বহু জানা-অজানা নাম ও তথ্য। অবাক হতে হয়, স্কটিশ নামের সঙ্গেই দশ শতাংশ বাঙালির নামও রয়েছে এখানে। দেখা যায়, অ্যান্ডারসন, ম্যাকগ্রিগর, ক্যাম্পবেল, রস – এসব আর্মেনিয়ান নামের পাশাপাশি রয়েছে ব্যানার্জি, দে, মুখার্জি পদবীধারীরাও। আসলে এই বাঙালিরা সকলেই ছিলেন ধর্মান্তরিত। স্কটিশদের ফ্রি চার্চ মিশনের দ্বারা তাঁরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন, কলকাতার কৈলাস: ভূকৈলাস
স্কটল্যান্ডের ডাণ্ডি (Dundee) অঞ্চলের সঙ্গে কলকাতায় আসা স্কটিশদের যোগসূত্র পাওয়া যায়। বেশিরভাগ স্কটিশ এই ডান্ডি অঞ্চল থেকে এসেছিলেন বাংলায়। হুগলি, শ্রীরামপুর প্রভৃতি অঞ্চলের নানা জুটমিলে কাজ করতেন তাঁরা। এই তথ্য পাওয়া যায় ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অব ডাণ্ডির আর্কাইভে। সেখানে রক্ষিত কাগজপত্র থেকে জানা যায় বেশিরভাগই এসেছিলেন পাট ও বস্ত্র শিল্পে যোগ দিতে। শুধু ডান্ডি নয়, কবরের ফলক থেকে জানা যায় স্কটল্যান্ডের পেইস্লে, ব্রাউটিফেরি, সাদারল্যান্ডশায়ার, ফাইফ, ক্যামবেলটাউন থেকে এ শহরে লোক এসেছে। পাট ছাড়াও চা ও নীল চাষ, চিন থেকে আফিম আনা প্রভৃতি বহু কাজে তাঁরা অংশ নিয়েছেন, দেশ থেকে নিয়ে এসেছেন স্ত্রী ও সন্তানদের। সমাধি-ফলক থেকে জানা যায়, এঁদের অনেকের জীবন ছিল বড়ই সংক্ষিপ্ত। মৃতুর কারণ হিসেবে মূলত দায়ী ম্যালেরিয়া, জ্বর, পেটের অসুখ ইত্যাদি।
সমাধি ফলকের অধিকাংশ পাথরই স্কটল্যান্ড থেকে আনা, তারা বহন করছে ভিক্টোরিয়ান যুগের স্মৃতি। বেলে পাথর, গ্রানাইট, অ্যাবার্ডিন গ্রানাইট দিয়ে তৈরি ফলক অযত্নে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল। ইট আর সুরকির তৈরি সমাধিগুলিও ঢাকা পড়ে গেছিল আগাছার জঙ্গলে। কালের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে স্কটল্যান্ডের ছাপ সম্বলিত বেশ কিছু ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে নষ্ট হতে শুরু করেছে লোহার ফলক, ফলকের ওপর খোদাই করা সীসার হরফ। সম্প্রতি সংস্কারের কাজ এগোচ্ছে দ্রুত গতিতে, বহু সংস্থার সমবেত প্রচেষ্টায়। গবেষকের দল এসেছেন স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যানড্রুজ ইউনিভার্সিটি থেকে। সঙ্গে রয়েছে এদেশে্র গবেষক ও যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, লরেটো কলেজ, ওমদয়াল, সেপ্ট (CEPT,আহমেদাবাদ) এবং ডেনমার্কের আরহাস স্কুল অব আর্কিটেকচারের ছাত্র-ছাত্রীরা। রীতিমত ওয়ার্কশপ করে স্কটিশ ঐতিহ্য আর তাদের শিকড়ের সন্ধানে তথ্য খোঁজা এবং সমাধিগুলির পুনর্নির্মান ও সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। যৌথ ভাবে ‘রয়্যাল কমিশন অব এনশিয়েন্ট অ্যান্ড হিস্টোরিক মনুমেন্টস ফর স্কটল্যান্ড’, কলকাতা স্কটিশ হেরিটেজ ট্রাস্ট (KSHT) এবং এই সিমেটারির মালিক সেন্ট অ্যানড্রুজ চার্চ কতৃপক্ষ নিয়োগ করেছে স্থপতি, কনজারভেশন কনট্রাকটর, আরবান ডিজাইনার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মেটেরিয়াল রিসার্চার এবং উদ্যান বিশেষজ্ঞ। সাহায্য করেছে তাদের নথিতে থাকা পুরোনো কবরের ছবি এবং তথ্য দিয়ে।
এখন পর্যন্ত ১৭৮৩ টি কবর খুঁজে বার করে তাদের সঠিকভাবে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ডিজিটাল রেকর্ড তৈরির কাজ চলছে। আরো দুই থেকে তিন হাজার সমাধি রয়েছে এখানে। ১৯৮৭-র এপ্রিলে অজ্ঞাত পরিচয় কিছু ফলক স্থানান্তরিত করা হয়েছে সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারিতে। প্রতিদিন নটা থেকে পাঁচটা পাঁচিলে ঘেরা স্কটিশ সিমেটারির গেট দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কেয়ারি করা ঘাসের মধ্যে শায়িত অসংখ্য মানুষকে যাঁদের অনেকেই আজও স্মরণীয়। প্রথমে নাম করতে হয় থমাস জোনস, উত্তর-পূর্ব ভারতে মিশনারি কার্যকলাপের পথিকৃৎ, যিনি খাসি বর্ণমালা প্রথম রোমান হরফে প্রচলন করেছিলেন। খাসি ভাষার চর্চা ও নানা অনুবাদে তাঁর অবদান অসীম। তাঁর নামে মেঘালয়ের শিলং-এ রয়েছে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন থমাস জোনস স্কুল অব মিশনস, থমাস জোনস সাইনড কলেজ। ১৮৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। খাসি-জয়ন্তিয়া অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাঁর কবরটির সংস্কার করা হয়েছে।
রয়েছেন জেমস কীড, যার নাম থেকে খিদিরপুর। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট কীড-এর আত্মীয় তিনি। আছেন জেন পেগ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কবি হেনরি পেগ-এর মা। এই হেনরি পেগ ছিলেন মনেপ্রাণে ভারতীয়, ডিরোজিও-র ভাবাদর্শে শিক্ষিত, বহু দেশাত্মবোধক কবিতার রচয়িতা। তাঁর মা (মৃত্যু ১৮৪৭ সালের ১২ জুলাই) শায়িত আছেন স্কটিশ সিমেটারিতে। রয়েছেন বেশ কিছু মিশনারি, যারা কেবল ধর্মপ্রচার নয়, এ দেশের উন্নতিকল্পে বহু জনহিতকর কাজ করেছেন। জন ম্যাকডোনাল্ড (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮০৭-১ সেপ্টেম্বর ১৮৪৭), স্যামুয়েল চার্টারস ম্যাকফারসন (১৮০৬-১৮৬০), জন অ্যাডাম (২০ মে ১৮০৩-২১ এপ্রিল ১৮৩১) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এঁদের মধ্যে জন অ্যাডাম বাংলা ভাষা শিখেছিলেন।
তিনি ভাবতেন যীশু খ্রিস্টই বাংলার গৌরাঙ্গ প্রভু। আর একজন বিখ্যাত বাঙালিকে পাওয়া যায় স্কটিশদের ভিড়ে। যিনি স্কটিশ ফ্রি চার্চ মিশনের দ্বারা দীক্ষিত হয়ে ধর্ম পরিবর্তন করেন। তিনি রেভারেন্ড লালবিহারী দে (১৮২৪-১৮৯১)। আলেকজান্ডার ডাফের ছাত্র ও পরবর্তীকালে তাঁর সহকর্মী লালবিহারী বাংলার উপকথার সংগ্রাহক, সংকলক ও অনুবাদক। তাঁর লেখা কৃষক জীবনী ‘গোবিন্দ সামন্ত’ খোদ চার্লস ডারউইনের প্রশংসা পেয়েছিল। রয়েছেন কর্তব্যরত অবস্থায় মাত্র আঠাশ বছর বয়সে নিহত পুলিশ জেমস হুইটলে।
খোঁজ চলছে এখনো অনেক অজানা ইতিহাসের যা বিস্মরণের মোড়ক খুলে এখনো প্রকাশ্যে আসে নি। স্কটিশ সিমেটারিতে সে সব নাম-না-জানা সমাধি পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয় যে অনেক সৌধের আকার ও আয়তন সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারির থেকে কোন অংশে কম নয়, বেশ কিছু সমাধিফলকের গঠনের অভিনবত্বে স্কটিশ ভাস্কর্যের ছাপ সুস্পষ্ট। তবু স্কটিশ সিমেটারি এখনো তুলনামূলকভাবে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। আয়তাকার, পিরামিড আকৃতির, স্তম্ভের মত, ফুলের কারুকাজ করা ক্রশ লাগানো, গম্বুজাকার – নানা স্থাপত্যের নিচে শুয়ে আছেন সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে এদেশে আসা একদল মানুষ, এই মাটিতেই চিরঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছেন তাঁরা।