Advertisment

Premium: কলকাতার গর্ব, এ দোকানে পান অভ্যাসে মজেছিলেন প্রধানমন্ত্রী থেকে উত্তম কুমার সকলে

Kolkata Heritage: দোকানের সামনেটা দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় দেওয়ালে বিশিষ্ট কিছু মানুষের দেওয়া কল্পতরুর পানের সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের তালিকায় প্রাক্তন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু থেকে শুরু করে পিসি সরকার (সিনিয়র) ,ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, উত্তম কুমার, মান্না দে সকলের নাম।

author-image
Shashi Ghosh
New Update
kolkata best paan shop kalpataru bhandar college street , কলকাতার সেরা পানের দোকান কল্পতরু ভাণ্ডার

পানের আসল রহস্য মশলায়। দোকান জুড়ে থরে থরে সাজানো রয়েছে মশলার কৌটো। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ

Paan Shop Kalpataru Bhandar: অনেক কিছুই পুরনো এই কলকাতা শহরে। এর মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্যময় খাবারও। আর কলকাতা শহরের মানুষ এমনিতেই খাদ্যরসিক। খেতে ভালোবাসেন। খাওয়া শেষে ভালোবেসে মুখে পুরে নেন মিষ্টি পানের খিলি। ঠোঁটের দু'কোণের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসে রস। তারপর অলস দুপুরে ধীরে ধীরে পান চিবোতে চিবোতে দিবানিদ্রা। বাঙালির এমন দৃশ্যের সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। যদিও অনলাইনের যুগে পানের চল এখন নেই বললেই চলে। বিয়ে বড়িতে ভুরিভোজের শেষে পানের বদলে জায়গা নিয়েছে আইসক্রিমের স্টল কিংবা মশলার প্যাকেট।

Advertisment

পানের বেলাতেই হয়েছে যত কার্পণ্য! যদিও পান এবং পানের দোকানের সঙ্গে রসাত্মক সম্পর্ক এখনও টিকে আছে কলকাতার বুকে। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ 'কল্পতরু'। কলকাতার প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী পান দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম এই পান দোকান। সংস্কৃত কলজের ঠিক পিছনে ৬/১, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট। কলেজ স্কোয়ারের ঠিক উলটো দিকের ফুটপাথে ছোট পানের দোকানটি আজও পুরনো স্মৃতি আগলে বসে আছে।

ইন্দিরা গাঁধী থেকে রাধাকৃষ্ণন, উত্তমকুমার থেকে মান্না দে, বহু গুণীজন এই দোকানের পান খেয়েছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। কল্পতরু ভাণ্ডারের বর্তমান কর্ণধার শ্যামল দত্ত। শ্যামল বাবু বলছিলেন এই দোকানের পুরনো ইতিহাস, "এই দোকান স্বাধীনতার সময়ের আগে থেকে। এখন বয়স প্রায় ৯৫ বছরের কাছাকাছি। প্রথমে আমাদের দোকান ছিল ঢাকায়। আমরা স্বর্ণ ব্যবাসায়ি পরিবারের। বাবা সবার থেকে আলাদা কিছু করতে চেয়েছিল। দেশভাগের সময় পরিবারের সবাই এখানে চলে আসে। বাবা ঈশ্বর রাধা বিনোদ দত্ত ও তার পাঁচ ভাইরা মিলে কলেজস্ট্রিটে শুরু করে এই পানের দোকান।

পান মানুষের পেটের জন্যে খুব ভালো একটি খাবার। হজম করতে সাহায্য করে। মানুষকে ভালো জিনিস খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে নিয়েই শুরু হয় কলকাতায় আমাদের দোকান। আমাদের দোকানের বাদশাহী পান মুখে নিয়ে দাঁড়ালে গন্ধে সকলে টের পেয়ে যেত কোন দোকানের পান খেয়েছে। আমাদের পান খেয়ে গুণগান করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসক থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বরাও। বাবার সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। দু'জনেই আসলে ওপার বাংলার লোক কিনা!"

publive-image
দোকানের মাঝ বরাবর ঝুলছে পানের খিলির নাম এবং দাম। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

দোকানের সামনেটা দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় দেওয়ালে বিশিষ্ট কিছু মানুষের দেওয়া কল্পতরুর পানের সার্টিফিকেট। এই সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের তালিকায় প্রাক্তন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু থেকে শুরু করে পিসি সরকার (সিনিয়র) ,ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, উত্তম কুমার, মান্না দে সকলের নাম। আর ঠিক মাঝ বরাবর ঝুলছে পানের খিলির নাম এবং দাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'বাদশাহী', 'বেনারস রুচি' 'মন মাতোয়ারা', 'মুখ বিলাস' ইত্যাদি। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে পানের খিলি। এর মধ্যে সব থেকে দামী বাদশাহী পানের খিলি দাম, ১০০১ টাকা। পানের যে এত দাম হতে পারে কল্পতরুর পানের দোকানে না এলে জানা যেত না। শ্যামল বাবুই বলছিলেন দামী পানের আসল রহস্য কোথায়! "যত দামি পান খান না কেন, একটা খিলি একেবারেই মুখে ঢুকে যাবে। দামটা আসলে মশলার, কায়দাটা পান সাজার। বাপ-কাকাদের আমল থেকে আমরা মশলা নিয়ে নানারকম গবেষণা করে আসছি। আমরা কোনও একটা কিছু চালু করলাম, তার কয়েক মাসের মধ্যে অন্য দোকানগুলো সেগুলো নকল করতে শুরু করে দিল। তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। আমরা আবার নতুন মশলা বানালাম।"

publive-image
কল্পতরু ভাণ্ডারের বর্তমান কর্ণধার শ্যামল দত্ত। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

মশলা আসে দেশের নানা জায়গা থেকে। সুপারির উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন শ্যামলবাবু, "ধরুন সুপারি। অসম থেকেও আসে আবার চেন্নাই থেকেও আসে। ভুবনেশ্বরের পান আমরা ব্যবহার করি। পান অনুযায়ী সুপারি কাটা হয়। কোনওটা কাগজের মতো পাতলা, কোনওটা একটু মোটা, তবক দেওয়া। এটাকে বলা হয় ডলার সুপারি। মিষ্টি পানের সঙ্গে পাতলা সুপারি দেওয়া হয়। আবার লম্বাটে এক ধরনের সুপারি ব্যবহার করি যা স্বাদে মিঠা, তবে লবঙ্গের নির্যাস আছে। আমরা এটার নাম দিয়েছি লঙ্কেশর। আবার মেওয়া সুপারি নামে এক ধরনের সুপারি ব্যবহার করি, সেটাও আমরা বাড়িতে বানাই।" প্রচলিত আছে এখানে এক সময় হেদোর পুকুর পাড়ের দুর্গা ঠাকুর দেখে বেরিয়ে, ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট হলের সামনে কল্পতরুর ভাণ্ডার থেকে পান খাওয়া বাঙালির ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছিল। কল্পতরু ভাণ্ডারের পান থেকে শুধু কলকাতা নয়, ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন রসিক মানুষজন ছুটে আসতেন।

publive-image
৯৫ বছরের পুরনো দোকানটি আজও পুরনো স্মৃতির ধারক-বাহক। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

শ্যামল দত্ত রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ দপ্তেরর চাকরি ছেড়েছেন শুধুমাত্র এই পানের দোকানের জন্য। চাকরি করলে হয়তো এতদিনে অবসরের সময় হয় যেত। যদিও শ্যামল বাবুর পরবর্তী প্রজন্মের এই ব্যবসার প্রতি কোন আগ্রহ নিয়ে। যান্ত্রিকতার যুগে ঐতিহ্য নিয়ে আবেগ দেখানোর সময় এখন বড্ড কম। যা কিছু পুরনো আছে সকলেই তো অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই করে যাচ্ছে। কল্পতরু পানের দোকানও একই দলের পথিক। বাঙালির পান খাওয়ার অভ্যাস গিয়েছে। যে কয়েকজনের এখনও রয়েছে তাদের জন্যেই ইতিহাসের ঝুলি আগলে বসে আছে কল্পতরুর মতন পানের দোকানেরা।

kolkata news kolkata college street
Advertisment